কক্সবাজারের চকোরিয়ার বাসিন্দা আব্দুল করিম। দাদার কাছ থেকেই শুনে আসছেন তার জেলায় রেলপথ আসবে।
চলবে রেলগাড়ি। জীবনের ৫৫ বছর কেটে গেলেও সে কথা কানেই থেকে যায়, বাস্তব হয়ে ওঠেনি।
আব্দুল করিম বলেন, আঁর (আমার) দাদার মুখত (মুখে) তো ওনিত্তাম, রেললাইন আঁইবোঐ, এতদিন নআঁইয়েই (আসেনি)। এহন আঁরার (আমাদের) স্বপ্ন পূরণ অইয়ে।
শুধু আব্দুল করিম নন, কক্সবাজারের মানুষের স্বপ্নের পেছনে রয়েছে ১৩৩ বছরেও কক্সবাজার রেলপথ না আসার নিদারুণ বাস্তবতা। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রথম পরিকল্পনা নেওয়া হয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের (সাবেক বার্মা) আকিয়াব বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের।
পরে ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুযায়ী কক্সবাজার পর্যন্ত বাদবাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি।
অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলপথ স্থাপনের জন্য ২০১০ সালে প্রথম প্রকল্প নেওয়া হয়। শুরুতে এটি ছিল ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ’ প্রকল্প। এতে মোট ১২৯ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কথা ছিল।
পরে রামু থেকে ঘুমধুম অংশের কাজ স্থগিত করা হয়। এখন চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ সমাপ্ত হলো।
মোট ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি ৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
প্রকল্পের জন্য কক্সবাজার জেলায় ১ হাজার ৩৬৫ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে নয়টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট ও ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট।
চলতি বছরের আগস্টের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেলপথটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রকল্পটি আরও পিছিয়ে যায় কয়েক মাস।
শেষ পর্যন্ত শনিবার (১১ নভেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মোট নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সংরক্ষিত বন এলাকায় রেলপথ স্থাপন করায় বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর দৃশ্যমান আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ সত্যিই চোখ জুড়ানো বাস্তবতা।
পরের চ্যালেঞ্জ মিয়ানমারের আপত্তি নিষ্পত্তি করে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের মাধ্যমে চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে রেলপথ চালু।
এতে বিনিয়োগ-শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক বন্ধন সহজতর হয়ে উঠবে। কৃষি-খামার ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বাজারজাত এবং রপ্তানি সুবিধার প্রসার ঘটবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনসাধারণের কর্মচাঞ্চল্য ও স্বচ্ছলতা বাড়বে।
Leave a Reply