রাজশাহীতে একের পর এক কৃষি জমির উপর খড়ক ঝুলানো হচ্ছে। এক দিকে অপরিকল্পীতভাবে কৃষি জমিতে পুকুর খনন হচ্ছে, অন্যদিকে শুরু হয়েছে কৃষি জমি প্লট আকারে বিক্রি। দুই মিলে এখন কৃষি জমি ও কৃষি হুমকির মুখে। কৃষি জমির উপর কালো থাবার জন্য কমেছে ফসল উৎপাদন। দেখা দিতে শুরু করেছে খাদ্য ঘাটতি। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল এক সময় খাদ্যের ভান্ডার হিসাবে খ্যাত ছিল। কিন্তু এখন খাদ্য সংকটের বেড়াজালে বন্দি। শুধু সঠিক পরিকল্পনা ও তদারকির অভাবে রাজশাহীতে গত ১০ বছরে কৃষি জমি কমেছে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর। বর্তমান কৃষি জমির উপর যে কালো থাবা পড়েছে তাতে আগামী ৫ বছর পর কৃষি জমি আরো ৫ হাজার হেক্টর কমে আসবে এমনটাই মনে করছে কৃষি বিভাগ। একের পর এক কৃষি জমির উপর প্রভাব ফেলানো হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে তাদের বিষয়টি জানা নেই, সাথে কিছু করারও নেই।
জানা গেছে, গত ২০১২ সাল থেকে রাজশাহীতে অপরিকল্পীতভাবে কৃষি জমিতে পুকুর খনন শুরু হয়। মাত্র ১২ বছরের বছরের ব্যাবধানে এখন রাজশাহীতে এতোটাই পুকুর খনন হয়েছে যার হিসাব জেলা প্রশাসন তো দুরের কথা, খোদ মৎস বিভাগেও নেই। কখনো বোরো ধানের জমিতে, আবার কখনো বন উজাড় করে, আবার কখনো উচু জমি নিচু করে খনন করা হয়েছে এসব পুকুর। এতে বোরো ধানের জমি দশ বছর আগে যা ছিল তার চেয়ে অনেক কমে এসেছে। যা কৃষির উপর হুমকি বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ।
অপরিকল্পীতভাবে কৃষি জমিতে পুকুর খননের পর এবার শুরু হয়েছে অপরিকল্পীতভাবে প্লট আকারে জমি বিক্রি। রাজশাহী নগরী থেকে গোদাগাড়ী পর্যন্ত রাস্তার দুই ধার, কাশিয়াডাঙ্গা থেকে দারুশা হয়ে কাকনহাট, নওহাটা থেকে মোহনপুর, বিনোদপুর থেকে পুঠিয়ার রাস্তার দুধারের জমি এখন প্লট হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। কিছু ব্যক্তি সাধারণ দামে এসব জমি ক্রয় করেছেন। এরপর তারা প্লট আকারে বেশি দামে বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। বিশেষ করে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থেকে রাজাবাড়ি হয়ে গোদাগাড়ী পর্যন্ত রাস্তার দুধারে প্লট আকারে বিক্রি করা জমির পরিমান বেশি।
দেখা গেছে, কৃষকদের এসব কৃষি জমি কম দামে কিনেছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা। এখন প্লটের আকার দিয়ে এসব জমি বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। সাধারণতো রাস্তার ধারের জমির মূল্য বেশি। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে খোদ কৃষকরাও তাদের জমি সামান্য উচু করে প্লট বানিয়ে বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন। খাল বিলের মধ্যে কৃষি জমি প্লটের আকার দেয়া হয়েছে। সাধারণ তো কৃষি জমি দেড় থেকে দুই লাখ কাঠায় বিক্রি হয়। আর প্লট আকারে বিক্রি করলে এই জমির দাম উঠে সাড়ে তিন লাখ থেকে প্রায় চার লাখ টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পবার দামকুড়া হতে কাকনহাট রোড়ে একটি কৃষি জমি সামান্য ভরাট করে সেখানে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন বাদশা ও আলেফ নামে দুই ব্যক্তি। এই জমির দুপাশে কৃষকরা শরিষা, গমসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করেছেন। জমির দাবিদার বাদশা ও আলেফ ওই কৃষি জমিতে লম্বা করে দুধারে ইট দিয়ে একটি সীমানা তৈরি করেছেন। মধ্যখানে রাস্তার জন্য জায়গা করা হয়েছে। জমির মধ্যে খন্ডখন্ড করে প্লট বানানো হয়েছে। প্লট বানিয়ে তা বিক্রি করা হবে বলে ব্যানার বসানো হয়েছে। কৃষি জমিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা এসব প্লটের আশপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। এমন জনশূণ্য এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য প্লট করে বিক্রি হচ্ছে কৃষি জমি। আবার দেখা গেছে, কিছু কিছু এলাকায় প্লট করা জমি বছরের পর বছর ধরে পড়ে আছে। বিক্রিও হয় না। এমনকি কৃষি কাজেও ব্যবহার হয় না।
কৃষি জমি প্লট আকারে বিক্রি করা পবার দারুশার আলেফ বলেন, জমিগুলো কৃষি হলেও তারা ভরাট করে এখন প্লট আকারে বিক্রি করছেন। জমিগুলো তার নিজের। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্লট তিনি বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান জমি বিক্রির পর তা কৃষি জমি বলেই রেজিষ্ট্রি করা হচ্ছে। পরে ক্রেতা সেটি বসতবাড়ি হিসাবে শ্রেণি পরিবর্তন করে নিতে হবে বলে জানান। কৃষি জমিতে প্লট কেনো জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জমি, আমি বিক্রি করবো, কিভাবে বিক্রি করবো সেটা আমার বেপার। রাজাবাড়ি এলাকায় কৃষি জমিতে প্লট করা ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার সর্তে জানান, গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুমোতিক্রমেই আমরা জমিগুলো প্লট আকারে বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। ভুমি অফিসকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। মূলত উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা কৃষি জমি প্লট আকারে বিক্রি করছেন বলেও মন্তব্য করেন।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নগর পরিকল্পক আজমেরি আফসারী জানান, আমরা নগর পরিকল্পনায় যেসব এলাকা চিহ্নিত করেছি তার বাইরে কৃষি জমিকে কেউ প্লট আকার বিক্রি করলে সেটি সম্পুর্ন অবৈধ। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যদি কেউ কৃষি জমিতে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে তাহলে খোঁজ নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজশাহী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শরিফুল ইসলাম জানান, বিষয়টি আমি গত কয়েকদিন আগে গোদাগাড়ীতে যাওয়ার সময় দেখেছি। রাস্তার ধারে কৃষি জমি প্লট আকারে বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এভাবে প্লট আকারে কৃষি জমি বিক্রি করা অবৈধ। বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে কথা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক নিদের্শ দিয়েছেন।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক মাজাহার হোসেন জানান, কৃষি জমিতে প্লট বা পুকুর খনন করা হলেও আমরা জানতে পারি না। এমনকি কেউ কৃষি অফিসে অভিযোগও করে না। আবার জানলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। কারণ কৃষকের জমি সে কিভাবে বিক্রি করবে সেটা তার ব্যাপার। কৃষি বিভাগের কোনো দায়বদ্ধতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে কৃষি অফিসের কোনো করণীয় নেই।
সূত্রঃ সিল্কসিটি নিউজ
Leave a Reply