বেতশিল্প বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যময় কুটির শিল্প। গৃহস্থালিতে বেতের ব্যবহার বহুবিধ। গৃহ নির্মাণে যেমন বেতের প্রয়োজন, তেমনি শৌখিন সজ্জাতেও বেতের কদর রয়েছে।
ভিন্ন ভিন্ন কাজে ভিন্ন ধরনের বেত ব্যবহূত হয়। বেতশিল্পে সাধারণত জালি ও গোল্লা বেত ব্যবহারের প্রচলন আছে। প্রধানত বুনন ও বাঁধানোর কাজে বেত ব্যবহূত হয়। নকশার ধরন বুঝে সরু ও মোটা বেতের বিভিন্ন ধরনের অংশ তুলে নিতে হয়।
সাধারণত জালি বেত দিয়ে চেয়ার, টেবিল, দোলনা, বাস্কেট, মহিলাদের ব্যাগ ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈরি হয়। আর গোল্লা বেত ব্যবহার হয় নিত্য ব্যবহার্য আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরির কাঠামোতে।
দেশের কোন কোন এলাকায় মহিলারা বেতের কাজে পুরুষদের চেয়ে বেশি দক্ষ। সেজন্য ঘরে বসে নারীরা রোজগারের সুযোগ পায় একসময় বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র।
তবে সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে চিরচেনা সেই চিত্র। বর্তমানে স্বল্প দামে হাতের নাগালে প্লাস্টিক সামগ্রী পাওয়ায় কুটির শিল্পের চাহিদা আর তেমন নেই।
এক সময় গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থলি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বেত ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করলেও, এখন বিলুপ্তির পথে এ শিল্পটি।
তাছাড়া দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে এ শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ ও বেত। এখন আর আগের মতো বাড়ির আশেপাশে বাঁশ ও বেত গাছ রাখছে না কেউ। সেগুলো কেটে বিভিন্ন চাষাবাদসহ দালান তৈরি করছে মানুষ।
তাই কাঁচামাল আর আগের মতো সহজেই পাওয়া যায় না। তাই প্লাস্টিক ও অন্যান্য দ্রব্যের পণ্য টেকসই ও স্বল্পমূল্যে পাওয়ায় সাধারণ মানুষের চোখ এখন সেগুলোর ওপর।
বাঁশ আর বেতকেই জীবিকার প্রধান বাহক হিসাবে আঁকড়ে রেখেছেন রাজশাহী জেলার গুটিকয়েক পরিবারের কিছু মানুষ। এই বাঁশ আর বেতই বর্তমানে তাদের জীবিকার প্রধান বাহক।
কিন্তু দিন দিন বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা।
জীবন জীবিকার তাগিদে তবুও বাবা-দাদার এই পেশাকে এখনও ধরে রেখেছে কিছু সংখ্যক পরিবার। বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের কদর আর তেমন নেই বললেই চলে। ঐতিহ্য হারাতে বসেছে শিল্পটি।
বাজারে বাঁশ-বেত শিল্প বিক্রি করতে আসা খগেন্দ্র চন্দ্র রায় ও কুতুয়া মুর্মু বলেন, বেত শিল্পের দুর্দিনে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক পরিবার বেতশিল্পকে আঁকড়ে ধরে আছেন।
অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও পূর্ব পুরুষের হাতেখড়ি এই পেশাকে কিছুতেই ছাড়তে পারেননি তারা।
প্রতিদিন তাদের তৈরি কিছু পণ্য পৌর বাজারসহ গ্রাম-গঞ্জে নিয়ে ফেরি করলে কিছু সৌখিন মানুষ আছে তাদের পণ্য কেনেন। বেলা শেষে যা বিক্রি হয় তা দিয়ে খাবার কিনে বাড়ি ফেরেন তারা। এভাবেই তাদের জীবন-জীবিকা চলে।
বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূলের দাম বেশি হওয়ায়, স্বল্প আয়ের এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা জানান, দৈনিক আয় খুবই কম হওয়ায় শত শত শিল্পী তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারছেন না। ফলে বাঁশ ও বেত শিল্পীদের খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
এক সময় দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি হতো গৃহস্থালী ও সৌখিন পণ্যসামগ্রী। বাড়ির পাশের ঝাঁর থেকে তরতাজা বাঁশ-বেত কেটে তৈরি করতেন হরেক রকমের পণ্য। এসব নিজেদের ব্যবহারের পাশাপাশি, বাজারে বিক্রি করে চলতো তাদের জীবন-যাপন।
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশ ও বেত সামগ্রী কালের বিবর্তনে হারানোর পথে।
এ শিল্প রক্ষায় কাউকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখতে শিল্পীরা অনেক ত্যাগ, কষ্ট, দুঃখ সহ্য করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে এখনো গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও বেতের তৈরি খোল, চাটাই, খোলুই, ধামা, টোনা, পালল্টা, মোড়া,দোলনা, বুক সেল্ফ কদাচিৎ চোখে পড়ে।
বাঁশ ও বেতের ঝাড় উজাড় করার ফলে কত দিন এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকে থাকবে, তা নিয়ে বেতশিল্পিদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।
Leave a Reply