ঈদের ছুটির চার দিনে ঢাকার সড়ক ছিল তুলনামূলক নির্জন। ফাঁকা ঢাকায় রাতে বেপরোয়া হয়ে উঠছিল ছিনতাইকারী ও চোর চক্র। অবশেষে তৎপর হয়েছে পুলিশ। ছিনতাইকারী গ্রেপ্তারে ঢাকায় শুরু হয়েছে বিশেষ অভিযান। রোববার এ অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩১ জন। তাদের মধ্যে ছিনতাইকারীর হাতে পুলিশ হত্যা মামলার এক আসামিও রয়েছে। পুলিশ বলছে, ছিনতাইকারীদের অধিকাংশ মাদকসেবী। এদের অনেকেই আসে ঢাকা শহরের আশপাশ থেকে।
মনিরুজ্জামান তালুকদার নামে পুলিশের ওই কনস্টেবল শনিবার ভোরে ফার্মগেট এলাকায় ছিনতাকারীর হাতে প্রাণ হারান। ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি শেরপুর থেকে ঢাকায় কর্মস্থলে ফিরছিলেন তিনি। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে রামপুরায় বিটিভি অফিসের সামনের রাস্তায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রাকিবুল হাসান রানা (৩০) নামে এক সাংবাদিক গুরুতর আহত হন। তিনি বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সহকারী প্রযোজক। ছিনতাইকারীরা তাঁর ব্যাগ এবং আরেক ব্যক্তির মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। তিনি এখন পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
ছিনতাইকারীর হাতে এক পুলিশ সদস্য নিহত ও এক সাংবাদিক গুরুতর আহত হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন। গতকাল রোববার সকালে প্রথম দফায় পুলিশের অপরাধ বিভাগের ডিসিদের নিয়ে জরুরি বৈঠক বসে। বিকেলে রাজধানীর ৫০ থানার ওসিদের নিয়ে আলাদা বৈঠক করেন এ বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, যে কোনো উপায়ে ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধের ব্যাপারে ওসিদের কড়া বার্তা দেওয়া হয়। কোনো এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে, তার দায়দায়িত্ব ওসিদের নিতে হবে এবং শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়। বৈঠকে রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চায়ের দোকান বন্ধ এবং পুলিশের টহল বাড়ানোরও সিদ্ধান্ত হয়।
ডিএমপির সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) তথ্য বলছে, রাজধানীতে ছয় হাজারের বেশি মানুষ ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৭ জন ছিনতাই এবং ৪ হাজার ৪৬১ জন ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িত।
ঈদের ছুটির প্রথম দিন মঙ্গলবার বাড্ডায় এক বাসায় দুর্ধর্ষ ডাকাতি হয়। দিনে-দুপুরে ওই বাসা থেকে ৪২ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা লুট করা হয়েছে। ওই পরিবার এখনও আতঙ্কে। এ ছাড়া মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে একটি বাসায় ঈদের আগের দিন চুরির ঘটনা ঘটে। ঈদের দিন রাজধানীর পল্লবীতেও চুরির ঘটনা ঘটে।
ঈদের আগের রাতে রাজধানীর আফতাবনগর হাটে গরু বিক্রি করে ফিরছিলেন জামালপুরের আটজন ব্যাপারী। পথে তাঁদের ২৮ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। এ ঘটনায় রোববার মামলা হয়েছে। ভুক্তভোগী জামালপুরের মেলান্দহের পশ্চিম থুরি এলাকার জয়নাল আবেদীন ফকির বলেন, তাঁরা আটজন গ্রাম থেকে ১৮টি গরু আফতাবনগর হাটে নিয়ে আসেন। ঈদের আগের রাতে সব গরু বিক্রির ২৮ লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। রাতেই ওই এলাকা থেকে একটি ট্রাকে উঠে জামালপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময় ট্রাকে আগে থেকে ৮-১০ জন ছিল। পরে আরও সাত-আটজন জামালপুর যাবে বলে ওই ট্রাকে ওঠে। ধামরাই এলাকায় আসার পর ছদ্মবেশী ডাকাত দল তাঁদের আটজনকে মারধর করে কাপড় দিয়ে মুখ ও হাত-পা বেঁধে রাস্তার পাশে ফেলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন ও সাভার থানা পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে।
পুলিশ বলছে, ঈদের ছুটিতে ঢাকায় এ পর্যন্ত সাত-আটটি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা তারা জানতে পেরেছে। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। কারণ, অনেক ভুক্তভোগী চুরি-ছিনতাইয়ের পরও পুলিশে অভিযোগ দেন না।
ডিএমপির ৫০টি থানা এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িতদের বিস্তারিত তথ্য হাতে আছে পুলিশের। পুলিশ বলছে, ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ও ডাকাত সবচেয়ে বেশি, আর সবচেয়ে কম মিরপুর বিভাগে। থানা হিসেবে ছিনতাইকারী ও ডাকাতি বেশি ভাটারা, শাহবাগ ও শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায়। এরপর রয়েছে হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, তেজগাঁও, রমনা, হাতিরঝিল ও উত্তরা পশ্চিম থানা। পুলিশের মিরপুর বিভাগের মধ্যে পল্লবীতে ছিনতাই-চুরির সংখ্যা বেশি। তবে ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দেন কম।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাত গভীর হলে ঢিলেঢালা নিরাপত্তার সুযোগে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এ ছাড়া অনেক এলাকায় দিন-দুপুরেও মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তাই পুলিশের পরিসংখ্যান দিয়ে চুরি-ছিনতাইয়ের আসল চিত্র পাওয়া দুষ্কর। চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার অনেকে পুলিশকে বিষয়টি জানান না। আবার অনেক সময় চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে ‘হারানোর জিডি’ নেওয়া হয়। প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে জিডি না নেওয়ার ব্যাপারে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ না থাকলেও এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো দেখাতে থানায় হারানোর জিডি নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজধানীতে চুরির ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৬০৩টি, ছিনতাই ১৪৫টি এবং ডাকাতি ২৭টি। আর চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় ১৯২টি চুরি, ৩৪টি ছিনতাই ও দুটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এ চক্রের ১৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তখন ডিবি জানায়, দিনে ওই চক্রের সদস্যরা অন্তত ৩০০ মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়া ঈদের ছুটিতে ঢাকায় ছিনতাই বা চুরির শিকার কত ব্যক্তি জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ কল করেছেন, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি সংস্থাটি।
ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘ছিনতাই-চুরির ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নিচ্ছি। বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। সাংবাদিককে ছুরিকাঘাতের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করেছি। পুলিশ হত্যায় জড়িত একজন ধরা পড়েছে।’
একই কথা বলেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ছিনতাই রোধে নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আর কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য মোবাইল টিম বাড়ানো হয়েছে। অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ঈদুল ফিতরের আগের তিন মাসে ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্দেহে ১ হাজার ৭৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার ফলে ওই সময় রাজধানীতে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ছিল।’
পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার এস এম জাহাঙ্গীর হাসান বলেন, ‘ছিনতাইকারীদের হাতে পুলিশ হত্যা ও সাংবাদিককে আহত করার ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি। ছিনতাই প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুলশান এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ের পর কোনো চায়ের দোকানও খোলা থাকবে না। গভীর রাত পর্যন্ত দোকান খোলা থাকলে দুর্বৃত্তরা সুযোগ নেয়।’
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। ছিনতাইপ্রবণ এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা নিয়েছে পুলিশ। ছিনতাইকারীদের মধ্যে কেউ জামিনে এসে পুরোনো পেশায় জড়াচ্ছে কিনা, তা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
মিরপুর থানার ওসি মুহাম্মদ মহসিন বলেন, রোববারের অভিযানে ছিনতাইকারী চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ভিড়ের মধ্যে নারীদের ধাক্কা দিয়ে বিশেষ কৌশলে ছিনতাই করে থাকে।
যেভাবে পুলিশ হত্যা
‘কী কাজ করিস, মোবাইল মানিব্যাগ দে’– এটা বলার পরপরই পুলিশ কনস্টেবল বলেন, ‘চাকরি করি।’ এরপর তাঁর কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তিন ছিনতাইকারী। তবে তা ছাড়ছিলেন না মনিরুজ্জামান তালুকদার। এরপর ছিনতাইকারীরা তাঁকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে সব কিছু কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এই তথ্য পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে একজন অভিযুক্ত আসামি।
মনিরুজ্জামান হত্যায় জড়িত অভিযোগে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছে। শনিবার রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের প্রেপ্তার করা হয়। ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম সবুর বলেন, পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। যে চারজনকে এরই মধ্যে আমরা গ্রেপ্তার করেছি, তার মধ্যে একজন পুলিশ হত্যার দায় স্বীকার করেছে। নিহত মনিরুজ্জামান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
সন্তানের নিথর দেহ জড়িয়ে বাবা-মায়ের আহাজারি
এদিকে শেরপুর প্রতিনিধি জানান, শনিবার রাতেই পুলিশ সদস্য মনিরুজ্জামানের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার কুরুয়ায় নেওয়া হয়। এ সময় স্বামীর মরদেহ দেখে কেঁদে ওঠেন রুমি আক্তার। সন্তানের নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে আহাজারি করতে থাকেন নিহতের বাবা-মা। মনিরুজ্জামানের দুই সন্তান রয়েছে। কুরুয়া ঈদগাঁ মাঠে মনিরুজ্জামানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, এলাকাবাসী ও স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। জানাজা শেষে তাঁর লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শেরপুরের পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বলেন, শিগগিরই নিহত মনিরুজ্জামানের পরিবারের কাছে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ছাড়া এ বাহিনীর কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে তাঁর পরিবারকে ধাপে ধাপে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন পুলিশ প্রধান। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হত্যার শিকার মনিরুজ্জামান যেন ন্যায়বিচার পান, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply