চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বহুল প্রতীক্ষিত রেলপথ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ। আর পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হলেই নতুন এ রেল পথে চালানো যাবে ট্রেন। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করার উদ্দেশ্যে দ্রুতগতিতে কাজ চলছে।
৯০ শতাংশ কাজ শেষ হলেই পাহাড়-সমুদ্রের শহর কক্সবাজারে ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে ছুটে চলবে ট্রেন। বাংলাদেশ রেল নেটওয়ার্কে ৪৫তম জেলা হিসেবে যুক্ত হবে কক্সবাজার।
সেপ্টেম্বরের পরে বাকি যে কাজ থাকবে সেগুলো ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের যে মেয়াদ রয়েছে, এর মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি এসব তথ্য জানান দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে ওই ১০০ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ রেলপথে রয়েছে নয়টি স্টেশন। এর মধ্যে প্রায় পাঁচটি স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে। ওই সব স্টেশনে শেষ মুহূর্তে চলছে টাইলস ও ফ্লোরিংয়ের কাজ।
চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথে রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতু। ওই সেতু দিয়ে ট্রেনগুলোকে এ মুহূর্তে ধীরে ধীরে চলাচল করতে হচ্ছে। এ সেতু ব্যবহার করে কীভাবে দ্রুতগতির ট্রেনগুলো চলাচল করবে, সে নিয়ে একটা সংশয় ছিল প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তাই সেতুর সক্ষমতা বাড়িয়ে কীভাবে ট্রেন চালানো যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বুয়েট প্রতিবেদন দিয়েছে যে সেতুটি আপগ্রেড করে এর ওপর দিয়ে ট্রেন চালানো যাবে।
ওই রেলপথ ট্রেন চালানোর জন্য উপযুক্ত হলে শুরুর দিকে মাত্র একটি ট্রেন চালানোর কথা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে চালু হবে আরও বাণিজ্যিক ট্রেন। এছাড়া পর্যটকদের জন্য বিশেষ ট্রেন চালানোরও পরিকল্পনা রয়েছে।
ইতোমধ্যে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন সার্ভিস চালানোর জন্য দুটি প্রস্তাবিত সময় রেল ভবনে জমা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে প্রথম প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকা স্টেশন থেকে রাত ৮টা ১৫ মিনিটে ট্রেন ছেড়ে কক্সবাজার পৌঁছাবে ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে এবং কক্সবাজার থেকে সকাল ১০টায় ছেড়ে ট্রেন ঢাকায় পৌঁছাবে ৭টা ১৫ মিনিটে। দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুসারে, ঢাকা থেকে রাত ১১টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে ট্রেন পৌঁছাবে কক্সবাজারে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে এবং কক্সবাজার থেকে দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে ঢাকায় ট্রেন পৌঁছাবে রাত ১০টায়।
এ পথে কেমন ভাড়া হবে, বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ ট্রেনের মতোই এ পথের ভাড়া নির্ধারণ করা হবে। তবে, বিশেষ টুরিস্ট ট্রেন চলাচল শুরু হলে তার ভাড়া আলাদা হতে পারে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ। ওই পথে বর্তমানে তিনটি ট্রেন চলাচল করছে। এর মধ্যে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন ও একটি তেলের ট্যাংকার। রেলপথ অবকাঠামো দুর্বলতার কারণে ওই পথে চলাচল করা ট্রেনগুলো প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৪৮ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে। যদিও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথে যেসব টুরিস্ট ট্রেন চালানোর কথা ভাবা হচ্ছে সেগুলোর পরিচালন গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ব্রড গেজ ট্রেনের ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার এবং মিটার গেজ ট্রেনের ক্ষেত্রে ৮০ কিলোমিটার।
প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান বলেন, এ প্রকল্পের কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হলে আমরা ট্রেন চালাতে পারব। আমাকে বলা হয়েছে সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। আশা করি সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কাজ শেষ হবে।
তিনি আরও বলেন, এ সময়ের মধ্যে কক্সবাজারে আইকনিক ঝিনুক আকৃতির স্টেশনের কাজও শেষ হবে। এটির কাজ বর্তমানে ৮৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। আমাদের পুরো আকর্ষণ ও আগ্রহের জায়গা ছিল স্টেশনটি। ফলে ছোট স্টেশনগুলোকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আপাতত চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালানো যাবে। আমার নয়টি স্টেশনের মধ্যে পাঁচটির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি চারটির কাজও দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে।
এ পথের স্টেশন ও ট্রেন কীভাবে পরিচালিত হতে পারে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের স্টেশন মাস্টার ও লোকোমোটিভ মাস্টারের সংকট রয়েছে। এগুলো আপাতত অন্য জায়গা থেকে এনেও চালু করব। রাতারাতি নতুন করে নেওয়া যাবে না। পুরোনো যারা আছেন তাদের দিয়েই আপাতত কাজ চালাতে হবে।
জানা যায়, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু ও কালভার্ট, বিভিন্ন শ্রেণির ৯৬টি লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করা হয়েছে। হাতি চলাচলের জন্য রয়েছে আন্ডারপাস। নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে, এগুলো হলো- দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৮ সালে ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি।
এ প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলায় প্রায় এক বছর আগেই তা সমাপ্ত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে স্লিপার বসানোসহ ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। টাইলস, ফ্লোরিং ও পাথর বসানোসহ শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী তিন মাস পর এ পথে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।
২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। রেলপথটি নির্মিত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।
Leave a Reply