রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের একটি বাসার বাসিন্দা আরাফাত-সঞ্চিতা দম্পতি। গত বছরের কোরবানির ঈদে স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে বিমানে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরেই মাথায় হাত আরাফাতের। দরজা কোনোভাবেই খুলতে পারছিলেন না। মোবাইলের এক্সেস থেকে বাসায় লাগানো ক্যামেরায় দেখেন চার ক্যামেরার দুটি কাজ করছে, বাকি দুটি বন্ধ।
দেয়াল টপকে বাসার কাটা গ্রিল দিয়ে দারোয়ানকে নিয়ে ঢুকে দেখেন সব এলোমেলো। বাসার রুমের অনেক কিছু ভাঙা, বাসার সব অলঙ্কার খোয়া গেছে। বিয়ের সব গহনা চুরির খবরে ঈদ মাটি করে ঢাকায় ফেরেন স্ত্রী সঞ্চিতাও। সিসিটিভিতে দেখা যায়, মাস্ক পরা, ফুলহাতা শার্ট পরিহিত ব্যক্তি ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন।
ওই বছর ফাঁকা রাজধানীর হাতিরঝিল, যাত্রাবাড়ী মিরপুরও উত্তরার বেশ কয়েকটি বাসায় চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সে তুলনায় গত ঈদুল ফিতরে ফাঁকা রাজধানীর নিরাপত্তা ভালোভাবেই নিশ্চিত করা গেছে বলে দাবি ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের। অতীতের মতো ফাঁকা ঢাকায় যেন চুরি-ডাকাতির ঘটনায় পুলিশকে বিব্রত হতে না হয় সেজন্য সকল বিভাগকে ঈদ নিরাপত্তায় কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।
এবারের ঈদে ফাঁকা ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, গত ঈদ নিরাপত্তার দিক থেকে ভালো গেছে। গত ঈদের ন্যায় এবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তবে এবার টার্গেট দুটি। এক, ঈদে রাজধানী খালি হয়ে যায়, রাস্তায় ছিনতাই ও বাসা-বাড়িতে চুরি-ডাকাতির ঘটনা রোধে বিশেষ ব্যবস্থা ও নজরদারি থাকবে।
আরেকটি হচ্ছে, কোরবানির পশুর হাটের নিরাপত্তা। গরু ব্যবসায়ীদের নগদ লেনদেনে পুলিশ নিরাপত্তা দেবে। বাসা-বাড়ি ও গরুর হাট মিলিয়ে মাঠে থাকবে অতিরিক্ত ফোর্স। থাকবে গোয়েন্দা নজরদারি।
বৃহস্পতিবার(২২ জুন) ডিএমপি সদর দপ্তরে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ঈদে ফাঁকা ঢাকায় যাতে চুরি ডাকাতি না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেব। ঢাকাবাসীর প্রতি অনুরোধ করব, আপনারা যখন ৪-৫ দিনের জন্য বাসা ফাঁকা রেখে গ্রামের বাড়িতে যাবেন, তখন দয়া করে মূল্যবান বস্তু অর্থাৎ নগদ টাকা এবং গহনা খালি বাসায় না রেখে ব্যাংকে রাখেন বা নিকট আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব বা যারা থাকবেন তাদের কাছে জমা রেখে যাবেন। ফাঁকা বাসায় কোনো দুষ্কৃতিকারী যদি ঢুকে তাহলে মূল্যবান বস্তু চুরির ভয় থাকবে না।
ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজকের সভায় ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা মনিটরিং; বাস, রেল ও লঞ্চ স্টেশন কেন্দ্রিক নিরাপত্তা; গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ ও গমনাগমন; বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক নিরাপত্তা; ঈদ জামাত ও ঈদ পরবর্তী সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সভায় অংশ নেওয়া ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপস) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, এবারের ঈদে ঢাকার ফাঁকা অলি-গলিতে টহল বাড়ানো হবে। সড়কে বাড়বে চেকপোস্ট। বাসা-বাড়ির সিসিটিভি মনিটরিং করতে বাসা মালিকদের অনুরোধ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রত্যেক বাসায় যারা পাহারায় দায়িত্বে থাকেন, তাদের নম্বর থাকবে পুলিশের কাছে। পুলিশের নম্বরও তাদের দেওয়া থাকবে। বাসা-বাড়িতে নিরাপত্তায় লাগানো সিসি ক্যামেরাগুলো সচল আছে কিনা তাও চেক করা হবে। আমাদের কমান্ড কন্ট্রোল রুম থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। পাশাপাশি ডিএমপির সিসিটিভি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখা হবে। সিঁধেল চোর ডাকাতদের ধরতে ডিএমপি কমিশনার সবাইকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফাঁকা ঢাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এজন্য চুরি ও ডাকাতির ডাটাবেজ অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত পলাতক চোর, ডাকাতদের গ্রেপ্তার ও যথাসম্ভব নজরদারি বাড়ানো ও অভিযান পরিচালনা করতে সব বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তায় অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন(র্যাব)। এবারের ঈদে নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে পুলিশের এ এলিট ফোর্স।
র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যারা ঈদ করতে গ্রামের বাড়িতে যান তাদের ঢাকায় বাসা-বাড়ি আছে। এগুলোর নিরাপত্তায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা অনুরোধ করব, কেউ যদি খালি বাসা-বাড়ির নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন আমাদের জানাতে পারেন আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমাদের নজরদারি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম অনেক বেশে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষ যেন নির্বিঘ্নে যাত্রা করতে পারেন কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়তে না হয় সেজন্য র্যাবের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। ঈদে ফাঁকা রাজধানীর ও ঘরমুখো মানুষ যাতে ছিনতাইকারী ও মলমপার্টির খপ্পরে না পড়েন সেজন্য আমাদের গোয়েন্দা শাখার লোকজন কাজ করছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঈদের সময় মার্কেট, শপিং-মলগুলোতে মানুষের ভিড় হয়। সেখানে ছিনতাইকারী ও মলমপার্টির খপ্পরে পড়েন অনেকে। অনেকে কেনাকাটা করতে গিয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ঈদযাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে ও কেউ যেন প্রতারণার শিকার না হন সেজন্য বিভিন্ন লঞ্চ, ফেরি ঘাট, বাস স্টপেজে বিশেষ নজরদারি থাকবে, গোয়েন্দা সদস্যরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবেন।
কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে ইজারা নিয়ে চাঁদাবাজি ও জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক সময় কৃত্রিম রাসায়নিক দ্রব্য খাইয়ে কোরবানির পশু মোটা তাজাকরণ করা হয়। অনেকে নানাভাবে প্রতারিত হন। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কোরবানির পশুর চামড়া মজুত ও দাম কমিয়ে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছি। এবার যেন নগরবাসী প্রতারিত না হন ন্যায্য মূল্য পান সেজন্য আমরা নজরদারি রাখছি, বলেন এ র্যাব কর্মকর্তা।
কমান্ডার মঈন বলেন, ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে আমরা বিশেষ নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। অতীতে জঙ্গি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম চলমান আছে। ঈদে সামগ্রিক নিরাপত্তায় আমরা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। ঈদকে কেন্দ্র করে কোনো জঙ্গি হামলার শঙ্কা এখনো নেই। তবে যেহেতু শোলাকিয়াসহ ঈদ জামায়াতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ঈদের দিন ও ঈদ পরবর্তীতে দোকান-পাট ও মার্কেট খালি হয়ে যায়। তৎপরতা থাকে না। এই সময় যেন চুরি ডাকাতির ঘটনা না ঘটে সেজন্য যার যার মালিকানা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতা বোধ করলে নিকটস্থ পুলিশকে জানাতে বলা হয়েছে। নিরাপত্তায় নিয়োজিত দারোয়ান ও নিরাপত্তা কর্মীদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশ কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply