গেল প্রায় পাঁচ বছর থেকে রাজশাহীর চাহিদা মেটাচ্ছে দেশি জাতের গরু। কোরবানির মৌসুমকে সামনে রেখে খামারিরা প্রতিবছরই দেশি জাতের গরু লালন-পালন করছেন।
তাই ঈদের আগে দেশি জাতের গরু উদ্বৃত্তই থাকছে রাজশাহীতে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রাজশাহীতে এবারও চাহিদার তুলনায় ৭০ হাজারেরও বেশি কোরবানির পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। ঈদের মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও রাজশাহীর পশুর হাটে ক্রেতা নেই। তাই এখনও জমেনি পশুর হাট। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ডামাডোলে যেন কোরবানির পশু কেনার তোড়জোড় নেই। তাই পশু কেনাকাটায় পড়েছে ভাটা। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২১ জুন সিটি নির্বাচনের পরই রাজশাহীর প্রার্থী ও ভোটাররা একযোগে কোরবানির পশুর হাটমুখী হবেন।
এদিকে করোনা সংকটের পর থেকে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রাজশাহীতেও গরুর মাংসের দাম হু হু করে বাড়ছে। প্রান্তিক খামারিদের দাবি- নানা কারণে গেল কয়েক বছর থেকে গবাদি পশুর খাবারের দাম বাড়ছে। এ কারণে গবাদি পশুর লালন-পালনের খরচও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তাই দেশি গরুর দাম বাড়ছে। এজন্য কোরবানির পশুরও দাম বাড়ছে। তবে উদ্বৃত্ত থাকায় এ বছরও কোরবানির পশু আমদানির দরকার নেই।
রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের তেবাড়িয়া গ্রামের খামারি গোলাম মোস্তফা বলেন, করোনা মহামারির সময় থেকে মূলত গোখাদ্যের দাম বেড়েই চলেছে। খড়-ভুসিসহ অন্যান্য গোখাদ্যের দাম গেল তিন বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এর সঙ্গে বেড়েছে বিদ্যুৎ খরচও। এর মধ্যে অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা খরচও রয়েছে। এভাবে মোটা অংকের পুঁজি বিনিয়োগ করে কোরবানির মৌসুমকে সামনে রেখে প্রায় বছরজুড়ে গরু-ছাগল লালন-পালন করতে হয়। সব মিলিয়ে বর্তমান বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে গরু-ছাগলের দামও বাড়ছে বলে জানান তিনি।
পাশের দীঘির পারিলা গ্রামের জয়নাল হোসেন বলেন, তিনি কোরবানির হাট ধরার জন্য বাড়িতে ষাঁড় লালন-পালন করছেন। তার মতো গ্রামের গেরস্ত বাড়ির লোকজন বাড়ি বাড়িতে অন্তত একটি করে হলেও কোরবানির জন্য গরু লালন-পালন করেছেন। বছরজুড়েই বাড়ি বাড়িতে গরু-ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। আর এভাবেই অন্যান্য কৃষি কাজের পাশাপাশি গবাদি পশু পালনেও নিরব বিপ্লব ঘটে গেছে। যার সুফল ভোগ করছে পুরো দেশ। বেশ কয়েক বছর থেকে আর কোরবানির মৌসুমে গরু আমদানি করতে হয় না। দেশি জাতের গরু উদ্বৃত্ত থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়া পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের মথুরা গ্রামের নূরুল আমিন বলেন, কোরবানির ঈদ ঘনিয়ে এসেছে। হাটে বিক্রির জন্য এ বছরও দুটি ষাঁড় লালন-পালন করেছেন। কোরবানির হাটে সেই ষাঁড় গরুগুলো এক থেকে দেড় লাখ টাকা দাম উঠবে বলে তার প্রত্যাশা। দুই বছর আগে এর একটি ৪০ হাজার ও অন্যটি ৫০ হাজার টাকায় কিনেছেন। সম্পূর্ণ দেশি পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করেছেন। কোনো রকম হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করেননি। তাই এগুলোর ভালো দাম পাবেন বলেই আশা করছেন তিনি।
রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ পশুর হাট হচ্ছে ‘সিটি হাট’। এ হাটের ইজারাদার ফারুক হোসেন ডাবলু বলেন, কোরবানির মৌসুমকে সামনে রেখে এবারও হাটে দেশি জাতের গরুরেই আমদানি বেশি। তাই আগের মতো ভারত থেকে পশু আমদানির প্রয়োজন নেই। হাটে এখন পর্যন্ত কোরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। তবে ক্রেতা নেই। রাজশাহীর মানুষ এখন নির্বাচনমুখী। সবাই ভোট নিয়েই ব্যস্ত। ঈদের এখনও প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি, আর ভোটের বাকি এক সপ্তাহ। ধারণা করা হচ্ছে, ভোটের পরপরই সর্ববৃহৎ এ পশুর হাট পুরোদমে জমে উঠবে। বর্তমানে সপ্তাহে দুই দুদিন (রোববার ও বুধবার) সিটি হাট বসছে। এক সপ্তাহ পর প্রতিদিনই হাট বসবে। তখন হাটে তিল ধারণের ঠাঁই থাকবে না।
রাজশাহী প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে রাজশাহীতে ঈদুল আজহায় ৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৭টি পশু কোরবানি করা হয়েছে। আর আগের বছর যেই পরিমাণ পশু জবাই হয়, পরের বছর সেই পরিমাণ গরুই কোরবানির জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তাই সেই হিসেবে এ বছরও (২০২৩) একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে এবার যে পরিমাণ পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে তা এ লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ রাজশাহী জেলায় এবার ৪ লাখ কোরবানির উপযোগী পশু রয়েছে। এর মধ্যে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া রয়েছে। ঈদে রাজশাহীর বিভিন্ন হাটে বিক্রি করা হবে এসব কোরবানির পশু।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, রাজশাহী জেলায় এবার চাহিদার চেয়েও বেশি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০২৩ সালে রাজশাহীতে ঈদুল আজহায় ৩ লাখ ২৪ হাজার ৯৭৭টি পশু কোরবানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কোরবানি উপযোগী পশু রয়েছে ৪ লাখ। সেই হিসেবে ৭০ হাজারের বেশি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে এ সংখ্যাও ছাড়িয়ে যাবে। এখনও রাজশাহীর নয় উপজেলা থেকে পশু লালন-পালনের তথ্য আসছে বলেও উল্লেখ করেন এ পশু সম্পদ কর্মকর্তা।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও দেশি জাতের পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ হবে। আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই। আর কোরবানির পশুর উদ্বৃত্ত থাকায় ঈদে প্রান্তিক খামারি ও ক্রেতা উভয়ের জন্যই পশু কেনাবেচার সুবিধাজনক পরিবেশ থাকবে। তাই বাজার স্বাভাবিক রাখতে কোনোভাবেই যেন সীমান্ত গলিয়ে ঈদে ভারতীয় গরু আসতে না পারে সেজন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
Leave a Reply