শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক চিঠি নিয়ে বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে-রুয়েটে। ওই চিঠিতে ‘অবৈধ নিয়োগ বোর্ডের’ নিয়োগে পাওয়া ১৩৭ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর চাকরি বাতিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও রুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দাবি, এই নিয়োগে কোনো ধরনেরই অনিয়ম হয় নি। রুয়েটের আইন-কানুন মেনেই নিয়োগ বোর্ড হয়েছে।
তবে এমন পরিস্থিতিতে চাকরি হারানো শঙ্কায় রয়েছেন নিয়োগপ্রাপ্তরা। তারা বলছেন, চাকরির দুই বছরের মাথায় এ ধরনের অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে এর দায়ও রুয়েট কর্তৃপক্ষের।
জানা গেছে, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২১ সালের পহেলা জুন তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর সবাই ঠিকঠাকই চাকরি করছেন। বেতন-ভাতা যথারীতি পাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক চিঠিতে তাদের চাকরি বাতিল করতে বলেছে। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে তাদের জীবন-জীবিকা।
জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার উপসচিব মোছা. রোখছানা বেগম এ নির্দেশনা দিয়ে রুয়েটের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্যের কাছে চিঠি পাঠান। মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠি আসার পরে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে তারা বিক্ষোভও করেছেন। এরপর ঈদের ছুটি শুরু হয়েছিল। এখন আবার তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ফলে রুয়েট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
রুয়েট সূত্র জানায়, এই ১৩৭ জন রুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সেখের আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন। নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন। এটি নিয়েই আপত্তি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৩ এর ১০ (৩) এবং ১১ (৮) ধারার প্রক্রিয়া অনুসরণ না করায় আইনের মৌখিক প্রিন্সিপাল অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গৃহীত ও সম্পাদিত কার্যক্রম শুরু থেকে বাতিল অর্থাৎ এ সংক্রান্ত সব নিয়োগ বাতিল করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হলো।’
অথচ রুয়েট অর্ডিন্যান্স এ ১০ ধারার ৩ উপধারায় বলা আছে, উপাচার্যের পদ শূন্য হলে কিংবা ছুটি, অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, শূন্যপদে নবনিযুক্ত উপাচার্য কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিংবা উপাচার্য পুনরায় স্বীয় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত চ্যান্সেলরের ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত না থাকা সাপেক্ষে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (উপ-উপাচার্য) উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করবেন।
তবে ওই নিয়োগের সময় রুয়েটের উপ-উপাচার্য পদটি শূন্য ছিল। তাই দায়িত্বে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার। এক্ষেত্রে রুয়েটের আইনের ১১ এর ৮ উপধারায় বলা আছে, ‘ভাইস-চ্যান্সেলর তার বিবেচনায় প্রয়োজন মনে করলে তার যে কোনো ক্ষমতা ও দায়িত্ব সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে অর্পণ করতে পারবেন’।
চাকরি হারানোর শঙ্কায় থাকা রুয়েটের সেকশন অফিসার রাইসুল ইসলাম রোজ বলেন, ‘কে উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন বা কারা নিয়োগ বোর্ডে আছেন- এসব বিষয় একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে আমার জানার প্রয়োজন নেই। আমি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেছি। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। আমার চাকরি হয়েছে। যথারীতি চাকরি করে যাচ্ছি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন অসঙ্গতি থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জবাবদিহি করবে। কিন্তু মন্ত্রণালয় চাকরি বাতিল করে আমাদের ভুক্তভোগী করতে পারে না। এটি অন্যায় ও অমানবিক’।
তিনি আরো বলেন, ‘আর একমাস পর আমাদের চাকরি দুই বছর পূর্ণ হবে। তখন চাকরি স্থায়ীকরণ হবে। আর এখন একটা ষড়যন্ত্র করে এটা আটকানো হচ্ছে। ইউজিসির তদন্ত কমিটি ভিসির মেয়াদের শেষদিন এসে তদন্ত করেছে। চারদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই চাকরি বাতিল করতে বলেছে। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।
১৩৭ জনের তালিকায় থাকা আরেক সেকশন অফিসার মামুন-অর-রশীদ বলেন, ‘২০১৯ সালে এই নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। তারপর লিখিত, মৌখিক পরীক্ষা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের যোগ্য মনে করে চাকরি দিয়েছে। সিন্ডিকেট তা অনুমোদন করেছে। যদি কোন নিয়মের ব্যতায় হয় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায়ী। একজন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে আমরা তো ঠিক করে দিতে পারি না যে, কে ভিসি থাকবেন, কে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি হবেন। এর দায়বদ্ধতা একজন প্রার্থী হিসেবে আমার নয়। এখন সরকারি চাকরির বয়সও শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাদের চাকরি কেড়ে নেওয়া হলে এটা অবিচার করা হবে। তাদের কারণে আমরা কেন ভুক্তভোগী হবো?’
ওই নিয়োগে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আ.ফ.ম মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে একজন অতিরিক্ত সচিব আমাদের নিয়োগকে বৈধতা দিয়েছেন। সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তিনি নিয়োগ অনুমোদন দিয়েছেন। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই নিয়োগ বাতিল করতে বলছে। কেন এই নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা তা আমাদের বোধগম্য নয়। নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি অমানবিকও। তাই আমরা এটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন বলেন, ‘নিয়োগে কোন অনিয়ম হয়নি। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছিল। তবে একটি তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা দিয়ে মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।’
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে রুয়েটের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসির এই বিষয়গুলো দেখার সুযোগ নেই। নিয়োগ বাতিলেরও ক্ষমতা আমার নেই। আমি সিন্ডিকেট সভাও আহ্বান করতে পারি না। কেবল রুটিন দায়িত্ব পালন করছি। নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ হলে তিনিই এই চিঠির বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন’।
Leave a Reply