চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) অফিসে সেবা পেতে চরম হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। দালালকে ঘুষ ছাড়া পাস করানো হয় না ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায়। টাকার বিনিময়ে মেলে ফিটনেসবিহীন গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটও।
সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, দালালদের তৎপরতা চলে বিআরটিএ’র এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে। মূলত তারাই দালালদের পৃষ্ঠপোষক। তাই বন্ধ হয় না বিআরটিএ কার্যালয়ের দুর্নীতি এবং দালালদের অপতৎপরতা।
ভুক্তভোগীরা জানান, লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়নের ক্ষেত্রে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। কাগজপত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের শান্তিমোড় এলাকার আব্দুল মতিন ভাগনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য এক দালালকে কয়েক দফায় নয় হাজার টাকা দেন। নয় মাস পার হলেও দালাল তাকে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বিরক্ত হয়ে গতকাল রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিআরটিএ অফিসের পাশে থাকা এক দালালের দোকানে গিয়ে তাকে হট্টগোল করতে দেখা যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে শান্ত করেন।
♦
♦
এ বিষয়ে আব্দুল মতিন জানান, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি চার হাজার ৪৯৭ টাকা। কিন্তু কয়েক দফায় দালালকে তিনি নয় হাজার টাকা দিয়েছেন। এখনও লাইসেন্স পাননি। দালাল শুধু ঘুরাচ্ছেন।
সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে ওই দালাল এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে, পাশের আরেক দালালের সঙ্গে পরিচয় গোপন করে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, কাগজপত্রসহ প্রাথমিক খরচ এক হাজার টাকা দিতে হবে। কাগজপত্র দেওয়ার পর শুধু ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে অফিসে যেতে হবে। বাকি কাজ আমরাই করব। পুরো প্রক্রিয়া শেষে করতে অর্থাৎ ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পেতে সাত থেকে আট হাজার মতো টাকা খরচ হতে পারে।
পরীক্ষা ছাড়া পাস করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটাও সম্ভব। তবে, নতুন সহকারী পরিচালক (এডি) আসার পর একটু কঠিন হয়ে গেছে। এখন কত খরচ হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
♦
♦
সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়ন পরিষদের সরজন গ্রামের জাহারুল ইসলাম (৩২) জানান, এক লোক (দালাল) ধরে কাজ করছি। পাঁচ মাস আগে করতে দিয়েছি। এখন বারবার এসে ঘুরে যাচ্ছি। আজ আবারও এসেছি ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর অফিস থেকে বলা হলো পরে আসেন।
সম্প্রতি হিরো মোটরসাইকেল কিনেছেন সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের চাটাইডুবি গ্রামের ওবাইদুল হক। মালিকানা পরিবর্তনের জন্য গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি (১০০ সিসির জন্য) চার হাজার ৪২৫ টাকা এবং ১০০ সিসির ওপরে চার হাজার ৮৬৩ টাকা হলেও দালালকে তিনি দিয়েছেন সাত হাজার ১০০ টাকা।
তিনি বলেন, মালিকানা পরিবর্তন করতেও হয়রানির শিকার হতে হয়। ৭৭ হাজার টাকায় গাড়ি কিনে মালিকানা পরিবর্তন করতে খরচ হয়েছে সাত হাজার ১০০ টাকা। অফিসে ঘোরাঘুরি তো আছেই।
প্রবাসী তরিকুল ইসলাম বলেন, ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে দিয়েছি। দালাল আমার কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আজ সরাসরি অফিসে এসে জিজ্ঞেস করলাম। এখন তারা বলছে, মে মাসের আগে দেবে না। এদিকে বিদেশ চলে যাব, এভাবে সময়ক্ষেপণ হতে থাকলে বিপদে পড়ে যাব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে তিন মাসের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ শেষ করেছেন সদর উপজেলার রানিহাটি এলাকার আবু সালেহ। প্রশিক্ষণ শেষে টিটিসি’র পক্ষ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের যাবতীয় কাজ করে দেওয়ার কথা থাকলেও আবু সালেহের কাছ থেকে এ বাবদ আড়াই হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।
♦
♦
আবু সালেহ বলেন, আমরা মোট ৮০ জন প্রশিক্ষণার্থী ছিলাম। এর মধ্যে ৬০ জনের ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া সম্পন্ন হলেও আমিসহ আরও ২০ জনের এখনও বাকি আছে। আজ আবার এসেছি, কিন্তু অফিস থেকে বলছে টিটিসি’র সঙ্গে কথা বলতে। অন্যদিকে, টিটিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, বিআরটিএ-কে জোর করে কিছুই বলা যাবে না। কারণ, আগামীতে তাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
শিবগঞ্জ উপজেলার ধাইনগর ইউনিয়নের লাউঘাট্টা গ্রামের ব্যবসায়ী কামরুল হাসান (৪০)। তিনি দালালকে আট হাজার টাকা দিয়েছেন। ৬০ দিনের মধ্যে লাইসেন্স দেওয়ার কথা। কিন্তু গত ছয় দিন অফিস ঘুরেও কোনো সুরাহা করতে পারেননি।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, পরীক্ষা না দিয়েও পাস করানোর ঘটনা ঘটে এখানে। দালাল না ধরলে কোনো কাজই হয় না। আবার ধরলেও যথাসময়ে সম্পন্ন হয় না। হয়রানির যেন শেষ নেই।
সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য দুই হাজার ৭৭২ টাকা এবং অপেশাদার লাইসেন্সের জন্য চার হাজার ৪৯৭ টাকা নির্ধারিত হলেও আদায় করা হচ্ছে সাত থেকে নয় হাজার টাকা পর্যন্ত।
এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ, এর সঙ্গে সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। অদক্ষ চালক লাইসেন্স পেয়ে গাড়ি চালালে অথবা সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চললে এর পরিণতি কী হতে পারে তা সবার জানা। এসব কারণে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তাই সরকারের উচিত এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, বিআরটিএ কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করা।
এদিকে, বিআরটিএ অফিসের টয়লেটের দরজাও তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে কেউ সেটি ব্যবহার করতে পারছেন না। এছাড়া টয়লেটের ওপরে ও পাশে বিভিন্ন নথিপত্র স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সেবাগ্রহীতা কামরুল হাসান (২৮) ঢাকা পোস্টকে বলেন, টয়লেটের অবস্থা ভালো নয়। এটি পুরাতন কাগজপত্রের স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহজামান হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের নিজস্ব ভবন নেই। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা নিজস্ব অফিসের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে জায়গা নির্ধারণ শেষ হয়েছে। বর্তমানে জেলা প্রশাসক কার্যালয়েরপাঁচটি রুম বিআরটিএ’র অফিস হিসেবে ব্যবহার করছি। অফিস নিচ তলায় হওয়ায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেবা নিতে আসা লোকজন আমাদের টয়লেট ব্যবহার করেন। এ কারণে বাধ্য হয়ে টয়লেটে তালা দেওয়া হয়েছে। তবে, কাউন্টারে এসে চাবি চাইলেই দেওয়া হয়।
টয়লেটের ভেতরে নথিপত্র রাখার প্রশ্নে তিনি বলেন, জায়গার স্বল্পতার কারণে টয়লেটের ওপরে কম গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রাখা হয়েছে।
তবে, বিআরটিএ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা অস্বীকার করেন এ কর্মকর্তা। বলেন, যানবাহনের বিভিন্ন কোম্পানির কারণেই লাইসেন্স প্রদানে দেরি হয়। এখানে অফিসের কোনো গাফিলতি নেই। এছাড়া আমাদের অফিসে মাত্র পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এত কম জনবল দিয়ে পুরো জেলাবাসীকে সেবা দেওয়া অসম্ভব। আমরা সঠিকভাবে জনসচেতনতামূলক কাজগুলোও করতে পারি না। কারণ, মাঠ পর্যায়ের কোনো কাজে গেলে কমপক্ষে তিন-চারজনকে সেখানে যেতে হয়। এ কারণে যথাযথ সেবা আমরা দিতে পারছি না। তবে, আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
♦
টিটিসি প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে বিআরটিএ’র নামে আড়াই হাজার টাকা নেওয়ার বিষয়ে সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহজামান হক বলেন, টাকা নেওয়ার বিষয়টি শুনেছি। তবে, এর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। দালালদের সঙ্গে আমাদের অফিসের কারও সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক। যা ২০২২ সালের মার্চ থেকে চালু করেছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মো. শাহজামান হক বলেন, গত ১১ মাসে ডোপ টেস্টে পাঁচ থেকে ছয়জনের পজিটিভ ফল পাওয়া গেছে। তাদের আবেদন তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করেছি আমরা।
বিআরটিএ অফিসের অভিযোগ বক্সে সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ পাওয়া যায় কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বক্সে হাতেগোনা কিছু লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে, এখন মানুষ অনেক সচেতন হয়েছেন। অনেকেই ফোনে যোগাযোগ করে বিভিন্ন সেবা নেন এবং অভিযোগ দেন। আর যেসব অভিযোগ বক্সে পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে বসার জায়গা নেই, লোকবল সংকট, দেরিতে কাজ হয়— এগুলো আছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলা বিআরটিএ কার্যালয় থেকে এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৩৪৫টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২ সালে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে নয় হাজার ৭০টি গাড়ির। গত বছর এ কার্যালয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করা হয় ছয় হাজার ৯৮৫টি। এর মধ্যে প্রদান করা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার এবং অপেক্ষমাণ রয়েছে তিন হাজার ৪৮৫টি আবেদন।
Leave a Reply