শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলাজুড়ে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। জেলা শহরসহ ছয় উপজেলায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং শিল্পকারখানায় বন্যার ক্ষতি প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। পুরো জেলা মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে সদরে ও তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে দাগনভূঞাতে।
ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মুশফিকুর রহমান পিপুল বলেন, বন্যার আঘাত দীর্ঘদিন ভোগাবে বড় বাজারের ব্যবসায়ীদের। ক্ষতির সঙ্গে এখন ঋণের চাপ যোগ হয়েছে।
ফেনী পৌর এলাকায় আনুমানিক ২০ হাজার দোকানপাট, গুদামঘর ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্তের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকা।
চাল আড়তদারদের দাবি, বাজারে ৬৪ জন চালের আড়তদার রয়েছেন। বন্যায় প্রায় ২৫ হাজার টন চাল নষ্ট হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১৫০ কোটি টাকা।
এবারের বন্যায় চিনির বাজারে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীরা একইসঙ্গে আটা, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ নানাবিধ পণ্য বিক্রি করে থাকেন। বড় বাজারের এসব আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের আনুমানিক ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করছেন তারা।
জানা গেছে, ফেনীতে চিনির ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) ক্রয় করেন ১০টি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে গড়ে ৭৮০ টন চিনি জেলায় সরবরাহ করেন। প্রতি টন চিনির পাইকারি দর ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সাধারণত গড়ে ৬০ টন চিনি বাজারে বিক্রির জন্য মজুদ রাখা হয় ।
শহরের তাকিয়া রোডের আরিফ ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক বলেন, দোকানে রাখা সাড়ে ৫০০ বস্তা চিনি, ১৫০ বস্তা আটা-ময়দা ও ৭০ বস্তা খইল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে টাকা অঙ্কে ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি গুণতে হয়েছে। একই সড়কের চৌধুরী ট্রেডার্সে ৫০০ বস্তা চিনি, ৪০০ বস্তা ভূষি, ১ হাজার বস্তা আটা ও ময়দা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে। জাফর এন্টারপ্রাইজে ৯০০ বস্তা আটা-ময়দা ও ৩০০ বস্তা চিনি পানিতে ভিজে নষ্ট হয়েছে।
পাইকারি বাজারে চিনি বস্তাপ্রতি ৬ হাজার ২০০ টাকা, আটা-ময়দা গড়ে ২ হাজার টাকা, ভূষি ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ হিসেবে উল্লেখিত ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে।
এদিকে বাজারে ১৩ জন আড়তদার আলু, পেঁয়াজ, আদার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বলে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে। বন্যায় প্রায় ১৫০ টন আলু, ১২০ টন পেঁয়াজ, ৭০ টন রসুন, ২৫ টন আদা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব পণ্যের আড়তগুলোর মধ্যে হাজী ইদ্রিস অ্যান্ড সন্স, আল্লাহর দান, রাজু এন্টারপ্রাইজ, হাজী জালাল, আয়েশা ট্রেডার্স, ভক্তি রঞ্জন সাহা, হরিপদ সাহা, ফৌজিয়া ট্রেডার্স ও মদিনা ট্রেডার্স অন্যতম।
এছাড়া ফেনী শহরে নিত্যপণ্য, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকানে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।
একইভাবে চালের আড়ত, মুড়ির আড়ত, জামান রোড, দর্জিপট্টি, খাজা আহম্মদ সড়ক, বড় মসজিদ গলিসহ বাজারের নিচতলার প্রায় সবগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফেনী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মুশফিকুর রহমান পিপুল বলেন, কেবল বাজারকে কেন্দ্র করেই বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে।
ফেনী শহর ব্যবসায়ী সমিতির শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কের পূর্বাংশের ব্যবসায়ী নেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, এ অংশে ব্যবসায়ীদের ১০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
শিল্প-কারখানায় ক্ষতি প্রায় ২০০ কোটি টাকা
ফেনীতে শতাব্দীর এ ভয়াবহ বন্যায় শিল্প- কলকারখানায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। জেলায় এককভাবে সর্বাধিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে স্টারলাইন গ্রুপের।
এ ব্যাপারে গ্রুপের পরিচালক মাঈন উদ্দিন বলেন, স্টারলাইন ফুড প্রোডাক্টস, পরিবহন, আটা-ময়দা ও মসলার মিল, মৎস্য ও পোল্ট্রি, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং, লাইভস্টক এবং সুইটস প্রোডাক্টসে ১১৪ কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বন্যায় ফেনী বিসিক ও ছাগলনাইয়ার নিজকুঞ্জরা এলাকায় বিসিকে অবস্থিত শিল্প কারখানাগুলোতে প্রায় ২৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন হীরা বিস্কুট প্রাইভেট লিমিটেডের আনোয়ার হোসেন ভূঞা।
এছাড়াও বন্যায় জেলায় ইটভাটার ৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জাফর উদ্দিন। তিনি বলেন, বন্যায় পোড়ানো ইট ও ইট তৈরির মাটি ধুয়ে এমন ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ইট তৈরির মেশিন ও সরঞ্জামও নষ্ট হয়ে গেছে।
পাঁচ উপজেলায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা
সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফুলগাজীতে। এবারের বন্যা এ উপজেলায় প্রায় ১৭ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে।
ফুলগাজীর মুন্সীরহাট বাজার কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল ওয়াব বাবুল বলেন, বাজারের ছোটবড় সাত শতাধিক দোকানে আনুমানিক প্রায় ৪ কোটি টাকা ক্ষতি হতে পারে।
নতুন মুন্সীরহাট বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফখরুদ্দিন কচি বলেন, নতুন মুন্সীরহাটে ১৭০টি দোকানে আনুমানিক প্রায় ১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
জিএমহাট ইউনিয়নের জিএমহাট বাজারের লামিম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল জলিল বলেন, দুই শতাধিক দোকানের এ বাজারের আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি টাকা। উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের কালিরহাট বাজারে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য এমদাদ হোসেন চৌধুরী রতন।
এবারের বন্যায় সদর ইউনিয়নের ফুলগাজী বাজারে পানি উঠেনি। তবে আগস্টের শুরুতে সৃষ্ট বন্যায় ফুলগাজী বাজারের প্রায় হাজার দোকানের ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০ কোটি টাকা বলে দাবি করেন সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হোসেন।
এদিকে বন্যায় ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, রাধানগর, শুভপুর ও ঘোপাল ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকার ৩২টি বাজার পানিতে তলিয়ে যায়। এতে অন্তত ২ হাজারেরও অধিক ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনাসহ মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ী নেতারা।
ছাগলনাইয়া জমদ্দার বাজারের ব্যবসায়ী নুর হোসেন মজুমদার বলেন, ভয়াবহ এ বন্যায় ছাগলনাইয়া উপজেলাব্যাপী দুই হাজারেরও হাজারেরও অধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পরশুরামে বন্যায় বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ১৩ কোটি ১০ লাখ বলে দাবি করেছেন তারা। বন্যায় উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের সুবার বাজার, বটতলী বাজার ও তুলাতলী মোড়ে প্রায় ৪০০ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় সোনাগাজীতে প্রায় এক কোটি টাকা এবং দাগনভূঞায় প্রায় ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
মুদ্রণে-কাগজে ক্ষতি ৪ কোটি টাকা
বন্যায় ফেনী শহরের মুদ্রণ ও কাগজ ব্যবসায়ীদের প্রায় ৪ কোটি টাকার মালামাল ও যন্ত্রপাতির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা। জেলা মুদ্রণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রাজীব নাথ বলেন, বন্যায় মুদ্ৰণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ট্রাংক রোডের পূর্বদিকে এবং ভেতরের বাজারের প্রেসগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একইভাবে কাগজ ব্যবসায়ীদের প্রায় ২ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকার কাগজ নষ্ট হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা।
কুটুমিয়া অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী মিনহাজ উদ্দিন বলেন, বন্যায় গুদামে রাখা ৬০ লাখ টাকার কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। একই পরিমাণ টাকার কাগজ নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিটি প্রেসের মালিক গোলাম হায়দার মজুমদার ঝন্টু।
শহরের বড় মসজিদ রোডের হেলাল এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. ইয়াছিন রাসেল বলেন, পানিতে ৫০ লাখ টাকার কাগজ নষ্ট হয়ে গেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না।
Leave a Reply