সুলভ মূল্যে মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে চলতি বছরের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে আমদানি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদন নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুসহ বিভিন্ন জাতের মোট ৪৮৮টি গরু জবাই করে এর মাংস নিলামে বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোকে। একই সঙ্গে ৬০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিতরণেরও দায়িত্ব পায় প্রতিষ্ঠানটি।
এ ছাড়া জবাই করা গরুর মাংস ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। বিক্রিত মাংসের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা। সমুদয় অর্থ জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নেন সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার প্রতিষ্ঠানের নামেই অবৈধভাবে আমদানি করা হয় ব্রাহমা জাতের গরুগুলো। বিমানবন্দরে সেগুলো জব্দও করা হয়। জব্দ করা গরুগুলো ঘুরেফিরে আবারও তার প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসে। শুধু ফিরে আসা নয়, গরুগুলো জবাই করে এর মাংস সাধারণ মানুষের মধ্যে সুলভ মূল্যে বিতরণেরও দায়িত্ব পায় প্রতিষ্ঠানটি। এখানেও প্রতারণার আশ্রয় নেন সাদিক অ্যাগ্রোর কর্ণধার ইমরান
অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, সাদিক অ্যাগ্রোকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে সাভার কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে অভিযান চালানো হয়েছে। এ ছাড়া সাদিক অ্যাগ্রোর সাভার, মোহাম্মদপুর ও নরসিংদীর ফার্মেও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
‘কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সাদিক অ্যাগ্রোর সাভারের ফার্মে দুই শতাধিক বিদেশি গরুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরুর সাতটি বাছুর রয়েছে।’
দুদকের গাজীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে আরেকটি দল সাদিক অ্যাগ্রোর নরসিংদীর ফার্মে অভিযান চালায়। তবে, ওই অভিযানে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। ফার্মটি ফাঁকা পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ২০২১ সালে বিদেশ থেকে আসা নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু কাস্টমস কর্তৃক জব্দ করা হয়। সেগুলো পরে লালন-পালনের জন্য সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে গত রোজার ঈদে গরুগুলোর মাংস বিক্রির জন্য একটি কমিটি করা হয় এবং মাংস বিক্রি করা হয়। অভিযানে সাভারে এসে একটি শেড থেকে পাঁচটি ব্রাহমা জাতের গরু ও সাতটি বাছুরের সন্ধান মিলেছে। এরপর একটি ঘরে ১৫ লাখ টাকা দামের আলোচিত সেই ছাগল পাওয়া গেছে। অভিযানে বেশকিছু তথ্য ও নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
অভিযান থেকে প্রাপ্ত বিস্তারিত তথ্য শিগগিরই প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করা হবে— জানান এ কর্মকর্তা।
কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার এবং দুদক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে গরুর মাংসের অস্বাভাবিক দাম থাকায় সরকার সুলভ মূল্যে মাংস বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ মার্চ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করে সরকার। রমজান উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে গরুর মাংস, মুরগি ও ডিম বিক্রি শুরু করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ওই কর্মসূচির আওতায় ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০ টাকা, খাসির মাংস ৯০০ টাকা, ড্রেসিং করা ব্রয়লার মুরগি ২৮০ টাকা এবং ডিম প্রতি পিস ৯.১৭ টাকা ( ডজন ১১০ টাকা) এবং তরল দুধ প্রতি লিটার ৮০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।
সরকারের ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুসহ বিভিন্ন বিদেশি জাতের মোট ৪৮৮টি গরু নিলামে কেজি হিসাবে দাম ধরে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনকে গরু জবাই ও মাংস বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লাইভ হিসাবে ওজন করে গরুর দাম ধরা হয় ভ্যাটসহ কেজিপ্রতি ৩২০ টাকা। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেন ওই দায়িত্ব পালন করেন।
অভিযোগ ওঠে, কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে যে ৪৮৮টি গরু সরবরাহ করা হয় তার সব জবাই করা হয়নি। এমনকি বিদেশি জাতের গরুর পরিবর্তে দেশীয় গরু জবাই করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কতটি গরু জবাই করা হয়েছিল, সরবরাহ করা গরুগুলোই জবাই করা হয়েছিল কি না এবং ৬০০ টাকা কেজি হিসাবে বিক্রি করার টাকা সরকারি কোষাগারে ঠিক মতো জমা হয়েছিল কি না— এসব প্রশ্নের জবাব পেতে দুদকের এ অভিযান।
কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে যে ৪৮৮টি গরু সরবরাহ করা হয় তার সব জবাই করা হয়নি। এমনকি বিদেশি জাতের গরুর পরিবর্তে দেশীয় গরু জবাই করা হয়। প্রকৃতপক্ষে কতটি গরু জবাই করা হয়েছিল, সরবরাহ করা গরুগুলোই জবাই করা হয়েছিল কি না এবং ৬০০ টাকা কেজি হিসাবে বিক্রি করার টাকা সরকারি কোষাগারে ঠিক মতো জমা হয়েছিল কি না— এসব প্রশ্নের জবাব পেতে দুদকের এ অভিযান
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া দুদক কর্মকর্তাদের ধারণা, উদ্ধার করা বিদেশি জাতের গরুগুলো গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে সরবরাহ করা। কারণ, সরকারিভাবে বিভিন্ন সময়ে কাস্টমস কিংবা বর্ডার গার্ড থেকে বিদেশি গরু জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে যা রাখা হয় গো-প্রজনন কেন্দ্রে।
দুদক কর্মকর্তারা এমনটিও ধারণা করছেন যে, বিদেশি জাতের ওই ৪৮৮টি গরুর মধ্যে অনেকগুলো হয়তো কোরবানির গরুর হাটে চড়া দামে বিক্রি করেছে সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরান।
তাদের মতে, জাল কাগজ তৈরির মাধ্যমে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরুর আমদানিকারক ছিল সাদিক অ্যাগ্রো। যা জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। পরে সেগুলো গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের হেফাজতে নেওয়া হয়। খামার কর্তৃপক্ষ সেই গরুগুলোর দায়িত্ব দেয় সাদিক অ্যাগ্রোকে। এটিও ভয়াবহ ‘জালিয়াতি’ হিসেবে দেখছে দুদক।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, করোনা মহামারির বিধিনিষেধের মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সে করে ১৮টি ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি করা হয়। এগুলোর মধ্যে একটি গরু আকাশপথেই মারা যায়। কিন্তু গরুগুলো গ্রহণ করার জন্য শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আমদানিকারকদের কেউ উপস্থিত হননি। পরে জানা যায়, গরুগুলোর আমদানিকারক সাদিক অ্যাগ্রো লিমিটেড।
দুদক কর্মকর্তারা এমনটিও ধারণা করছেন যে, বিদেশি জাতের ওই ৪৮৮টি গরুর মধ্যে অনেকগুলো হয়তো কোরবানির গরুর হাটে চড়া দামে বিক্রি করেছে সাদিক অ্যাগ্রোর ইমরান
সাদিক অ্যাগ্রো গরু আমদানির ক্ষেত্রে তিনটি জাল নথি ব্যবহার করে। সেগুলো হলো- গবাদিপশু আমদানি সংক্রান্ত একটি নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি), প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণী কোয়ারেন্টাইন বিভাগের কাছ থেকে একটি চিঠি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গবাদিপশু আমদানির অনুমতিপত্র। এর প্রতিটিই জাল হিসেবে চিহ্নিত করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। জাল নথি দিয়ে গরু আনার ঘটনায় ওই সময় মামলা হয়। আদালতের রায় আসে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষে। ফলে ওই ১৭টি ব্রাহমা গরু বাজেয়াপ্ত করে রাখা হয় কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে।
Leave a Reply