সিলেট ও চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের পর দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে (২০২২) চা উৎপাদনের হিসাবে পার্বত্য অঞ্চলকে পেছনে ফেলে টানা দুইবার দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছে উত্তরাঞ্চল। এ মৌসুমে পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা জাতীয় উৎপাদনের ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
সমতলে চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড করা জেলাগুলো হলো পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট। বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, দিন দিন উত্তরাঞ্চলে চা চাষের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা দেশে মোট ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি চা (মেড টি বা তৈরি চা) উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি। এর আগে ২০২১ সালে চা উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি। ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি ও ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছিলেন। সে অনুযায়ী পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায় স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে টবে, পরে পতিত জমিতে বাড়তে থাকে চা চাষ। এর ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তেঁতুলিয়ায় চায়ের বাগান গড়ে তোলে।
পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সমতল ভূমি চা চাষের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ফাইল ছবি
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প’ হাতে নেয়। উত্তরাঞ্চলে চায়ের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নেওয়া এই প্রকল্প ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলে। এর আওতায় চা-চাষিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাসহ ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল’-এর মাধ্যমে চায়ের আবাদ সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বল্প মূল্যে উচ্চফলনশীল চারা সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই জেলার পর ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের এই ৫ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৫৩টি নিবন্ধিত ও ৬ হাজার ৩০২টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার ৭৯ একর জমিতে চা হচ্ছে।
চা বোর্ড উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৪৮টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা অনুমোদন নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে ২৪টি ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি কারখানা চালু রয়েছে। এই কারখানাগুলো চা-চাষিদের কাছ থেকে সবুজ চা-পাতা কিনে তা থেকে চা তৈরি (মেড টি) করে। এরপর সেই চা চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের নিলাম বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন বলেন, পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সমতল ভূমি চা চাষের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এ জন্য চাষিদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে চা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এতে দিন দিন উত্তরাঞ্চলে চা চাষের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। চা চাষের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
Leave a Reply