আজ ২৫ শে মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বরোচিত গণহত্যা চালানোর এক ভয়াল স্মৃতির কালরাত এ ২৫ শে মার্চ। ১৯৭১ সালের এই রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে রচিত হয়েছিল বিশ্বের নৃশংসতম গণহত্যার এক কালো অধ্যায়। কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নামে মুক্তিকামী বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন শুরু হয় এই রাতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালের এই গণহত্যার দিনটিকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্মরণ করে আসছে জাতি।
২৫ শে মার্চ ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিন। সেদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মধ্য রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক নিয়ে ‘আপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের উপরে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। হিংস্র শ্বাপদের মতো জলপাই রঙের ট্যাংকগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ-ইপিআর ব্যারাকের দিকে ধেয়ে যেতে থাকে। রচিত হয় এক কুখ্যাত ইতিহাস। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ-ট্রাক বোঝাই করে নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানের সৈন্যরা ট্যাঙ্কসহ আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে শহরজুড়ে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে আধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। মুহুর্মুহু গুলিতে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডবে তখন মত্ত পাকিস্তানি বাহিনী। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়তে থাকে মৃত্যুর কোলে।
সেই রাত সোয়া ১টার দিকে একদল সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বঙ্গবন্ধু বীরের মতো দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নস্যাৎ করে দিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাক হায়েনার দল।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআর-এর ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। এই ওয়ারলেস বার্তা পৌঁছে যায় চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এ বার্তা গ্রহণ করে। তখন চট্টগ্রামে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের তৎকালীন শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়।
পাকিস্তানে পোড়া মাটি নীতি বাস্তবায়নে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না’। ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত্রি। এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত এই রাত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালি হত্যার মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ২৫ মার্চ কালো রাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত হয় বহুল প্রতীক্ষিত মহান স্বাধীনতা।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বর্বরোচিত হামলার সেই নৃশংস ঘটনার স্মরণে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ দশম জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫শে মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ২৫ শে মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধ করা হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা হবে, সর্বোপরি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে নারকীয় ও বর্বরোচিত এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবহিত করে গণহত্যাকারী ও তার দোসরদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি বাঙালি জাতি ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে নিহত সকল শহীদসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা ২ লক্ষ মা-বোনকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবে।
গণহত্যা দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
গণহত্যা দিবস পালন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সোমবার দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যৌথ উদ্যোগে গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
Leave a Reply