• আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল সহজ ও স্বল্প সময়ে খালাস নিশ্চিত
• লাইটারেজ জাহাজের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না, পরিবহন খরচ ও অপচয় হ্রাস পাবে
• এই প্রকল্প চালু হলে বছরে সরকারের প্রায় ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে
আমদানি করা জ্বালানি তেল জাহাজ থেকে সহজে, নিরাপদে, স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে খালাস করার জন্য গভীর সমুদ্রে ডাবল পাইপলাইনের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পের নির্মাণকাজ চলছে। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৬.৫৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি প্রায় ৯৭ শতাংশ। প্রকল্পটি চালু হলে ১১ দিনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল খালাস করা যায়, সেটির সময় কমে আসবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায়। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর লাইটার জাহাজের প্রয়োজন হবে না। এতে পরিবহন খরচ ও অপচয় হ্রাস পেয়ে সরকারের বাৎসরিক ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
প্রকল্প কর্মকর্তা মনজেদ আলী শান্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং এসপিএম উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রুড অয়েল এবং ফিনিসড প্রোডাক্ট আসত। সেটা মাদার ভেসেল থেকে লাইটারিং করে নিতে হয়। একটা মাদার ভেসেল থেকে লাইটারিং করতে ১০ থেকে ১১ দিন লাগে। এ জন্য আমাদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হতো এবং অনেক সময় লাগত। এই প্রকল্প চালু হলে সেটা আমরা ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই চিটাগং পৌঁছাতে পারব। এখানে আমাদের ৬টি ট্যাংক রয়েছে। ৩টি ফিনিসড প্রোডাক্ট আর ৩টি ক্রুড অয়েলের জন্য। আমাদের সুবিধা মতো আমরা ক্রুড অয়েল পাম্পিং করে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পারব।
প্রকল্পের তথ্য মতে, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল ও ফিনিশড প্রডাক্ট স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে এবং নিরাপদে খালাস করার জন্য ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীনস্থ কোম্পানি ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে চায়না পেট্রোলিয়ম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড।
এসপিএম বয়া মহেশখালী দ্বীপের পশ্চিম পাশে (বঙ্গোপসাগরে) স্থাপন করা হয়েছে। জাহাজ থেকে তেল সরাসরি পাম্প করা হবে; যা এসপিএম হয়ে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মাতাড়বাড়ি এলটিই (ল্যান্ড টার্মিনাল এন্ড) পর্যন্ত ও সেখান থেকে অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় নির্মিত স্টোরেজ ট্যাংকে জমা হবে। এসপিএম হতে ৩৬” ব্যাসের দুটি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল আনলোডিং করা হবে। ট্যাংক থেকে পাম্পিং-এর মাধ্যমে তেল প্রথমে অনশোর ও পরবর্তীতে অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে গহিরা এলটিই পর্যন্ত এসে আবার অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে কেইপিজেডের ভেতর দিয়ে ডাংগারচর পর্যন্ত এসে কর্ণফুলী নদী এইচডিডি পদ্ধতির মাধ্যমে ক্রস করে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ভেতর দিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পাঠানো হবে। ট্যাংক ফার্ম হতে ১৮” ব্যাসের ২টি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল এবং ডিজেল ডেলিভারি করা হবে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ৯০ একরের কাছাকাছি জায়গা অধিগ্রহণ করে প্রকল্পের জন্য ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটি পরিশোধিত তেলের জন্য ও তিনটি অপরিশোধিত তেলের জন্য। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৫০ হাজার ঘনমিটার। অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণক্ষমতা ৩০ হাজার ঘনমিটার। স্কাডা, প্রধান পাম্প, বুষ্টার পাম্প, জেনারেটর, মিটারিং স্টেশন, পিগিং স্টেশন, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাদি রয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় এখন পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। এইচডিডিসহ অফশোরে প্রায় ১১ কিলোমিটার নিয়ে ১৪৬ কি.মি. এবং অনশোর প্রায় ৭৪ কি. মি..পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। এসপিএম প্রকল্পটি পরিশোধন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। জ্বালানির তেলের মজুদ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং জোগানের নিরাপত্তা বাড়বে।
জানা গেছে, কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের নাব্যতা কম (মাত্র ৮-১৪ মি.) এবং চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে বড় ক্রুড ভেসেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এসব ক্রুড ভেসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করে থাকে এবং ছোট লাইটারেজ ভেসেলের মাধ্যমে ক্রুড আনলোডিং করা হয়। এভাবে ১১ দিনে একটি ১০০,০০০ (ডিউব্লিউটি) ট্যাংকার খালাস করা হয়। বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অধিক পরিমাণ ক্রুড অয়েল এবং এইচএসডি খালাস করা বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব হবে না। এ ছাড়া এই ধরনের পদ্ধতিতে তেল খালাস করা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল; প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে যা পরিহার করা সম্ভব। এসপিএমের বাৎসরিক আনলোডিং ক্ষমতা মোট ৯.০ মিলিয়ন মে. টন। ১২০,০০০ ডিডব্লিউটি ক্রুড অয়েল ট্যাংকার থেকে আনলোড করতে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগবে এবং ৭০,০০০ ডিডব্লিউটি ডিজেল ট্যাংকার থেকে আনলোড করতে সময় লাগবে ২৮ ঘণ্টা।
প্রকল্প কর্মকর্তা মনজেদ আলী শান্ত আরও বলেন, ইতোমধ্যেই আমাদের প্রকল্পের ৯৭ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি প্রকল্পের কমিশনিং এবং টেস্টিংয়ের কাজে যাব। কমিশনিং এবং টেস্টিংয়ের কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হলে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। এই প্রকল্প চালু হলে বছরে সরকারের প্রায় ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মোট ১৯১ একর জায়গার ওপরে এটা নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ও বাংলাদেশ সরকারের জিওজি।
তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য আলাদা কোম্পানি গঠন হতে যাচ্ছে। সেই কোম্পানি এটা পরিচালনা করবেন। এই প্রকল্পের দেশের অনেক লোকেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এসপিএম উইথ ডাবল পাইপ লাইনে দুটি পাইপ লাইনের মোট দূরত্ব হচ্ছে ২২০ কিলোমিটার। ২২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সমুদ্রের মধ্যে আর ৭৪ কিলোমিটার স্থলে। খুবই উন্নতমানের পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। সমুদ্রে থাকা পাইপ লিকেজ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কোথাও কোনো সমস্যা হলে আমাদের সংকেত পাঠাবে। পুরো প্রকল্পে সর্বাধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছে।
মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটি একটি জাতীয় প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাবিত ফেলবে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে এই প্রকল্প চালু হলে ৮শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। আর এই ৮০০ কোটি টাকা আমাদের রিজার্ভে যুক্ত হবে।
Leave a Reply