ভোর ৬টায় অন্ধকার কেটে হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। মুসল্লিদের সঙ্গে ফজরের নামাজ পড়ে কুয়াশাছন্ন মেঠো পথ দিয়ে মাঠের দিকে ছুটছে আবুজার রহমান, রফিকুল ইসলাম, তৌহিদুর রহমান, ওহিদুল ইসলাম ও আজিজুর রহমান। তারা সম্পর্কে একে অপরের চাচাতো-খালাতো ভাই। মাঠে গিয়ে খেজুর গাছ থেকে যে যার মতো রস সংগ্রহে ব্যস্ত। কেননা সকাল সকাল রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করে বাজারে নিতে হবে।
মাঠের খেজুর গাছ থেকে রস নামিয়ে তা বাড়িতে আনা হয়। এরপর উঠানের বড় উনুনে তাফাল বসিয়ে তাতে ঢালা হয়। আস্তে আস্তে জ্বাল দিতে হয় ও রস নাড়তে হয়। এভাবেই তৈরি হয় ঝোলা গুড় এবং পাটালি গুড়। এ প্রক্রিয়াটি করতে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। এর সে গুড় পাটালি গুলো দূর দুরন্ত থেকে অনেকে কিনতে আসে আবার অনেকে ভাড়ে করে হাটবাজার নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে।
গাছিরা জানান, গত বছর ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকেই গাছ কাটা এবং রস সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়। তবে সে সময় শীতের মাত্রা কম থাকায় রসের পরিমাণও কম ছিল। ফলে রস গুড় প্রেমীদের চাহিদা মতো সরবরাহ করা সম্ভব হতো না। তবে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে যশোরে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের থেকে তুলনামূলক রস ঝরার পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে লাভের মুখ দেখছেন গাছিরা।
তিনি বলেন, আমার এখানে ৩৫টা গাছ আছে। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ ভাড় করে গুড় বিক্রি করি। গুড়ের প্রকারভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। রস প্রতি ভাড় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
আবুজার রহমান নামে ওই গ্রামের এক গাছি বলেন, সকাল হলেই এই গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটলে রসের মিষ্টি গন্ধে প্রাণ ভরে যায়। প্রতিটা বাড়িতে কালটা যেন একটা উৎসবের সকাল। চুলায় গুড় জ্বাল দেওয়ার পর শিশুরা তাফালের পাশে বসে কাঠি, চামচ দিয়ে মিঠাই খায়। বিষয়টি দেখে আমাদেরও ভালো লাগে।
গাছিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সকাল ৮টা বাজতেই গাছির বাড়িতে হাজির বিধান ঘোষ নামের এক শিক্ষক। তিনি রস আর গুড় কিনতে এসেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাড়িতে মেয়ে, নাতি-পুতিরা এসেছে। তারা রসের পিঠে আর গুড় খেতে চেয়েছিল। তাই আগে থেকে এখানে বলে রেখেছিলাম। এখন রস গুড় নিত এসেছি। বর্তমানে এই গাছ কাটা পেশায় কেউ আসতে চায় না। তাই রস গুড় পাওয়া দুর্লভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটির বাজারমূল্য বৃদ্ধি এবং গাছিদের সহয়তা করলে এটি দেশের জন্য একটা ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে থাকবে।
ভগবানপুর গ্রামের ওহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ৪৩টা গাছ আছে। আজ ৬/৭টা রস হয়েছে। এই রস জ্বাল দিয়ে প্রায় ৫/৬ কেজি গুড় হবে। আমাদের বাপ দাদারা করতো, তাই আমরাও এ পেশার কিছু অংশ করছি। তবে এ পেশা টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক, এনজিও সংস্থাদের আমাদের পাশে থাকতে হবে। এটা প্রচুর খাটনির কাজ, কিন্তু তুলনামূলক লাভ কম।
ভগবানপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে শীতে জুবুথুবু অবস্থায় রসের ঠিলে গোচ্ছাছিল সলিম শেখ নামে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ গাছি। তিনি বলেন, আমি ২০ বছর ধরে লিজ নিয়ে খেজুর গাছ কাটি। পেটের দায়ে এ পেশায় কাজ করছি। সরকার গতবছর বিভিন্ন সহযোগিতার কথা বলেছিল, কিন্তু আমি কোনো সহযোগিতা পাইনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক ড. সুশান্ত তরফদার বলেন, এ বছর গুড়ের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গাছি তৈরি, তাদের সরঞ্জাম প্রদান এবং রপ্তানিমুখী করার জন্য নিরাপদভাবে গুড় উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে কৃষক যেমন লাভবান হবে, তেমনই দেশের রাজস্বও বাড়বে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, যশোরে প্রায় ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫০০ খেজুর গাছ রয়েছে। যার মধ্যে পূর্ণবয়স্ক গাছের সংখ্যা ৯ লাখ ৭৫ হাজার। এরমধ্যে প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার গাছ থেকে রস আহরণ করে তৈরি করা হচ্ছে গুড়।
Leave a Reply