দেখতে আকারে বড়, রসালো, সুমিষ্ট, সুন্দর গন্ধ ও গাঢ় লাল রঙের বৈশিষ্ট্যের কারণে মঙ্গলবাড়িয়ার লিচুর খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশে প্রসিদ্ধ কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার ‘মঙ্গলবাড়িয়া লিচু’।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া পৌর এলাকার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়া। এই গ্রামে প্রতিটি বাড়িতেই লিচুর আবাদ হওয়ায় এর নামকরণ হয় ‘মঙ্গলবাড়িয়া লিচু’। গ্রামের প্রায় সবার বাড়িতেই রয়েছে ১০/১২টি বা তার চেয়েও বেশি লিচু গাছ। এবার লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
মঙ্গলবাড়িয়া লিচুর কদর শুধু দেশেই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের নানা জায়গায় বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এই লিচু। মঙ্গলবাড়িয়া লিচুর প্রচুর চাহিদা থাকায় এলাকার মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে। লিচুর আবাদ করে এই গ্রামের মানুষ পেয়েছে সচ্ছলতা, বদলে গেছে তাদের জীবন। এবারও ভালো দাম পাবেন বলে আশা করেন চাষি ও পাইকাররা। এখানকার লিচুর স্বাদ নেওয়ার জন্য মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ভিড় করেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে এই গ্রামের এক ব্যক্তি সুদূর চীন থেকে লিচুর চারা এনে রোপণ করেছিলেন। গাছ বেড়ে লিচু ধরার পরে বোঝা যায় এটি অত্যন্ত সুস্বাদু একটি জাত। এরপর থেকে পুরো মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এ লিচুর চাষ। লিচুটির জাতের সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে এটি গ্রামের নামানুসারে ‘মঙ্গলবাড়িয়া লিচু’ বলে খ্যাত।
লিচু গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়ায় গিয়ে দেখা গেছে, লিচুর আবাদ বদলে দিয়েছে এই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা। লিচু চাষে ভাগ্য ফিরেছে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের হাজারও মানুষের। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় লিচু চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের। গ্রামজুড়েই এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে ছোটবড় লিচুগাছ। রাস্তার দুই পাশেও লিচুর বাগান। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে টসটসে লাল রঙের লিচু। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠান, বাড়ির সামনের অংশ, পুকুরপাড় ও খেতের আইলসহ সব জায়গায় শুধু লিচু গাছ। যেদিকেই চোখ যায়, লিচুর সমাহার।
অনেকে গাছ থেকে লিচু পাড়ছেন। লিচু থেকে পাতা সরিয়ে গুনে গুনে ৫০ থেকে ১০০টি করে আটি বাঁধছেন। কেউ লিচু ভর্তি গাছ ও ডালও কিনে রাখেন। লিচু পুরোদমে পাকলে সেসব গাছ ও ডাল থেকে লিচু তুলে নিয়ে যান তারা। লিচুর ভরা মৌসুমে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে চলছে উৎসবের আমেজ। দূর-দূরান্তের মানুষ আসছে লিচু কিনতে। এলাকার আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসছেন লিচুর মৌসুমে। এখান থেকে লিচু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতারা। প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকায়। তবে চাষিরা বলছেন আরও ১ সপ্তাহ গেলে দাম আরও বৃদ্ধি পাবে।
জানা গেছে, এখানকার অধিকাংশ লিচুই আগাম বিক্রি হয়ে যায়। পাইকাররা অগ্রিম গাছ কিনে অতিরিক্ত দামে লিচু বিক্রি করে থাকেন। এ লিচুর চাহিদা বেশি হওয়ায় ১৫ দিনের মধ্যেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। এ বছর ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে মঙ্গলবাড়িয়ায়।
পুরো গ্রামজুড়ে রয়েছে দুই শতাধিক লিচু বাগান। আট হাজারের অধিক গাছ আছে। এ বছর লিচুর ফলন ভালো হওয়ায় লিচুচাষি ও পাইকাররা ব্যাপক খুশি। তারা এবার ভালো লাভ করছেন বলে আশা করছেন।
মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুচাষিরা বলেন, আমাদের গাছের একটা লিচু খাইলে মনে করবেন অল্প টাকায় গোল্লা (মিষ্টি) খেলাম। প্রতিদিন ৭০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেন বেশিরভাগ লিচুচাষি। যা দিয়ে পরিবারের সব খরচ চলে।
লিচুচাষি হেলেনা আক্তার (৬০) বলেন, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামটি লিচু গ্রাম হিসেবেই পরিচিত। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই কম-বেশি লিচু গাছ আছে। আমার ২ ছেলে একজন প্রবাসী আরেকজন ঢাকায় চাকরি করে। যার ফলে বাড়িতে গাছগুলো আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়। আমার ১২টি গাছ গত বছর ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলাম। এ বছর ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারব বলে আশাবাদী। লিচু বিক্রির টাকা দিয়ে আমি ধান চাল কিনি, সংসারের খরচ মিটাই। ছেলেদের কাছে চাইতে হয় না।
লিচু কিনতে এসেছেন একই উপজেলার নজরুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, প্রতি বছরই লিচু কিনতে মঙ্গলবাড়িয়ায় আসি। লিচুর সিজন আসলে আত্মীয়-স্বজনরা ফোন দিয়ে লিচুর খোঁজখবর নেন। যার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে পাঠাতে হয়। এ লিচু খেতে অনেক সুস্বাদু।
লিচু বাগান ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয় আব্দুল হেলিম (৬৫) নামে এক ব্যাপারীর সঙ্গে। তিনি একই উপজেলার চন্ডিপাশা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জানান, প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আগাম লিচু গাছ কিনে থাকেন। এবারও কিনেছেন। একটি বাগানে ছোট বড় মিলিয়ে ১১০টি গাছ রয়েছে। ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে মুকুল আসার পূর্বেই কিনেছেন। মুকুল আসার পর থেকেই তিনি এখানে থেকে গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন অন্যবারের তুলনায় এই বাগানে লিচু কম হলেও লস হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই।
মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের মহসিনউজ্জামান (৫০) নামের এক চাষি বলেন, আমার জন্মের পূর্ব থেকে বাপ-দাদারা লিচু চাষ করতেন। আমার বাবা মাওলানা মাহতাব উদ্দিন বাড়ির উঠানে ও পুকুর পাড়ে শত শত চারা রোপণ করেছিলেন। বছর শেষে যা দিয়ে আমাদের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ খুব ভালো ভাবেই পূরণ হতো। এখন আমি ধান এবং সবজি চাষের জমিতে লিচুর বাগান করেছি। কারণ অল্প খরচে অধিক লাভবান হওয়া যায় লিচু চাষে। আমার এই বাগানে ৬০টি গাছ রয়েছে। ধারণা করছি ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব।
সাধারণত মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। পাশাপাশি সিংগাপুর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশেও মঙ্গলবাড়িয়া লিচু রপ্তানি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নূর-ই-আলম বলেন, পাকুন্দিয়ার ঐতিহ্য মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু। নিরাপদ লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যে আমাদের পরামর্শক্রমে পাকুন্দিয়ার চাষিরা হরমোন জাতীয় ওষুধ, লিচুর রঙ নষ্ট না হওয়ার জন্য ছত্রাকনাশক স্প্রে করে যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে আট হাজার লিচু গাছ আছে। এ বছর ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে শুধু মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকে পাকুন্দিয়ায় মঙ্গলবাড়িয়ার লিচু পাওয়া যাবে।
Leave a Reply