পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে দেড় কোটি প্রবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে থাকা ভোটে দায়িত্বরত ব্যক্তি, কর্মস্থল অন্য স্থানে হওয়ায় এবং পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিরাও থাকছেন ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার বাইরে।
তাই বিশাল এই নাগরিকদের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা আনার উপায় খুঁজছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
জানা গেছে, গত অক্টোবরে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে বৈঠক করে সুপারিশ গ্রহণ করছে। সেখানে প্রায় সকল পক্ষ থেকেই পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোটে আনার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার সুপারিশ করেছেন। এজন্য অনেকেই আইনে পরিবর্তন, পরিমার্জন করার কথাও বলছেন। কেননা, বিদ্যমান আইনে পোস্টাল ব্যালটে বা ডাকযোগে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এতে ভোটাররা ইচ্ছা থাকলেও উৎসাহ পান না বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যমান আইনে যা আছে
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচনি দায়িত্বে নিয়োজিত ভোটার, প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার, সরকারি চাকরিজীবী যিনি চাকরিসূত্রে নিজ এলাকার বাইরে বাস করেন এবং কারাবন্দিরা পোস্টাল ব্যালটে ভোটের আবেদন করতে পারেন।
আরপিও-এর ২৭ দফায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে তফশিল প্রকাশ হওয়ার তারিখ থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে এলাকার ভোটার সেই নির্বাচনি এলাকার রিটার্নিং অফিসারের কাছে ডাকযোগে ব্যালটে ভোট প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি ব্যালট পেপারের জন্য আবেদন করবেন এবং অনুরূপ প্রত্যেক আবেদনে ভোটারের নাম, ঠিকানা এবং ভোটার তালিকায় তার ক্রমিক নম্বর সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
রিটার্নিং অফিসার ভোটারের আবেদন পাওয়া পর, অনতিবিলম্বে ওই ভোটারের কাছে ডাকযোগে একটি ব্যালট পেপার এবং একটি খাম পাঠাবেন। সেই খামের ওপর তারিখসহ সার্টিফিকেট অব পোস্টিং-এর একটি ফরম থাকবে, যা ভোটার ডাকে প্রদানের সময় ডাকঘরের উপযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক পূরণ করা হবে।
কোনো ভোটার ডাকযোগে ব্যালটে ভোট প্রদানের জন্য তার ব্যালট পেপার পাওয়া পর, নির্ধারিত পদ্ধতিতে তার ভোট রেকর্ড করার পর ব্যালট পেপারটি তার কাছে প্রেরিত খামে ন্যূনতম বিলম্বের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের কাছে ডাকযোগে পাঠাবেন।
কেন্দ্রে গিয়ে ভোটদানে মার্কিং সিল ব্যবহার করতে হলেও পোস্টার ব্যালট পেপারে টিক (√) চিহ্ন দিতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দেশনা অনুসরণ করে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ব্যালট পেপারটি নির্ধারিত খামে রাখতে হবে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, তফশিল ঘোষণার পর ১৫ দিনের মধ্যে প্রবাসীদের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন করার এবং সেই ব্যালট পেপার ডাকযোগে পাঠানোর প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ। এছাড়া প্রবাসীসহ সংশ্লিষ্টরা তাদের কাজ ফেলে এই সুযোগ নিতে পারেন না। এজন্য এটা তাদের জন্য উৎসাহ সৃষ্টি করে না।
বিগত নির্বাচনে ইসির ভূমিকা ও ভোটারদের সাড়া
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন বেশ জোরালোভাবেই পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন পরিপত্র জারি করেছিল। এক্ষেত্রে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছিল পোস্টাল ব্যালট সরবরাহ করার জন্য। অন্যদিকে ডাক বিভাগকে অগ্রিম ডাকমাশুল ছাড়াই ব্যালট পৌঁছানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আবার বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি দিয়েছিল সংস্থাটি। কয়েদিদের ভোট দেওয়ার জন্য কারা মহাপরিদর্শককে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও বলেছিল কমিশন। কিন্তু এতে তেমন সাড়া পড়েনি। রাষ্ট্রপতি, তার সহধর্মিণী এবং কিছু সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া কেউ এতে সাড়া দেননি। বিশেষ করে প্রবাসীদের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। অথচ, প্রবাসী রয়েছে দেড় কোটির বেশি। আর ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও অন্যান্য) রয়েছে ৫০ লাখের মতো।
নির্বাচনের পর ইসির তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছিলেন, ডাকযোগে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে ভোট দিয়েছেন এক হাজার ৯৬১ জন ভোটার, যারা বিভিন্ন এলাকায় ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আবার অনেকের আবেদন যথাযথ প্রক্রিয়ায় না আসায় পোস্টাল ব্যালট পাঠানো হয়নি।
সংস্কার কমিশন যা ভাবছে
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, বর্তমান আইনে পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু প্রয়োগ হয় না। আমরা চাচ্ছি যারা বিদেশে আছেন কেবল তারা নন, যেন যারা দেশে আছেন, অক্ষম, নারী, কর্মস্থলের কারণে যারা এলাকার বাইরে আছেন, তাদের সকলের জন্য সুযোগটা রাখতে চাই। যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তাদের যেন সুযোগটা নিশ্চিত করা যায় সেটা ভাবা হচ্ছে। এতে একটা বিরাট অসুবিধা হচ্ছে, তাদের অনেকের আইডি কার্ড নেই। এক্ষেত্রে পাসপোর্টকে আমলে নেওয়া কথা ভাবছি।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, আমরা যাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি, তাদের সকলেই প্রায় প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থাটির কথা বলেছেন। আমাদের বড় ইস্যু হলো প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার অধিকার ও ভোটের অধিকার নিয়ে কী করা যায়, এই বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখব।
গত ২১ নভেম্বর সাবেক সচিব এএমএম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশনও আইন সংস্কার নিয়ে ভাবছেন। ইতোমধ্যে তারা একটি কমিটিও গঠন করেছেন। তবে সেই কমিশন সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে আসা প্রস্তাবের ভিত্তিতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে। জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদকে আইন সংস্কার সংক্রান্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
Leave a Reply