ঘণ্টার দীর্ঘ পথ। বেয়াড়া ধুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ে এসে যখন হানা দিচ্ছে জানালা দিয়ে, তখন বিমানের মতোই যেন শহর, জনপদ অতিক্রম করে ছুটছে তো ছুটছেই দূরপাল্লার বাস। জানালার পাশে সিট। কানে এয়ারফোন। ভ্যাপসা গরমে শরীর কাহিল মনে উৎফুল্লতার শেষ নেই। তবে মাঝেমধ্যে ধুলোবালির তরঙ্গ থেকে উঠে আসা ঝাপটাটা প্রশান্তির খোরাক জোগায় বৈকি।
গন্তব্য উত্তরবঙ্গের সুনসান নীরবতার শহর দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির। মন্দিরে পৌঁছাতেই চারদিকে সবুজের আবহ। গলিতে গলিতে ধূপধুনার গন্ধ। কোথাও কামিনী, কোথাও বা বেলি আবার কোথাও সন্ধ্যামালতীর মিষ্টি সৌরভে ভরপুর চারিধার।
কান্তজির মন্দির শ্রীকৃষ্ণের জন্য নিবেদিত। কালিয়াকান্ত জিউ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপনের জন্যই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে কান্তজিউ, কান্তজি বা কান্তজির। মন্দিরটির সুবাদে এলাকাটি কান্তনগর নামে পরিচিতি পায়। সে জন্য পরবর্তী সময়ে এর আরেক নাম হয়ে যায় কান্তনগরের মন্দির।
অভাবনীয় নির্মাণশৈলী চোখ নতজানু করে দেয়। জানলাম, নির্মাণকালে মন্দিরটির চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। তিনতলায় নির্মিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন। তবে এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো সারা দেহে বসানো পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। প্রায় ১৫০০০ টেরাকোটার ফলকসমৃদ্ধ এই মন্দির ছিল অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে সুন্দর মন্দির। শুধু তা–ই নয়, অবিভক্ত ভারতের ১১তম আশ্চর্য ছিল এটি।
তবে পোড়ামাটির ফলকগুলোর বিশেষত্ব আসলে অন্যখানে। এগুলো সাধারণ কোনো টেরাকোটার কাজ নয়। এর গায়ে লাগানো প্রতিটি ফলকে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। তবে কিছু ফলকে মুঘল আমলের চিত্রবর্ণনাও দেখতে পেলাম। তবে এসব ফলকের উপস্থাপন ছিল অনন্য, যা অন্যান্য টেরাকোটার নিদর্শনে দেখা যায় না। এর স্তম্ভের কার্নিশে সমসায়িক জীবন ও অভিজাত শ্রেণির শিকারের দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে মুঘল জীবনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। মুঘল বাদশাহদের শিকার ও কারুকার্যখচিত রথের দৃশ্যায়ন দেখা যায় এ ধাপে। তৃতীয় ধাপে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনির বিবরণ। রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি বর্ণিত আছে এই অংশে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সীতার বনবাস, বাকাসুর হত্যা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কাহিনি স্থান পেয়েছে এই ধাপে। তবে এই ধাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লৌকিক উপস্থাপন। শ্রীকৃষ্ণের কাহিনিসমূহকে এখানে জনসাধারণের জীবনের মতো চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক গল্পকথা। পৌরাণিক কাহিনির লৌকিক উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক
অনন্য নিদর্শন এই ফলকগুলো। শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরের নির্জন এই কান্তনগরে হাঁটতে গিয়ে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শিবমন্দির ও সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিশাল দিঘির সন্ধানও পেয়ে গেলাম।
এই মন্দিরে ব্যবহৃত এত উৎকৃষ্ট টেরাকোটার ফলক আপনি দেশের আর কোথাও দেখতে পাবেন না। কান্তজির মন্দিরের বিখ্যাত রাসমেলা দেখতেও চলে আসতে হবে দিনাজপুরে। কান্তনগরের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর কাছে নিঃসন্দেহে আকর্ষণের।
Leave a Reply