1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : editor :
  3. [email protected] : moshiur :
মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:০৪ পূর্বাহ্ন

পৌষের শীতে ধরাশায়ী উত্তরাঞ্চল, বাড়ছে গরম কাপড়ের চাহিদা

মহানগর রিপোর্ট :
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৩ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে

কথায় আছে— মাঘের শীতে বাঘ কাঁদে। কিন্তু মাঘ মাস না আসতেই পৌষের শীতে ধরাশায়ী উত্তরের জনপদ। দিন যতই যাচ্ছে হিম বাতাস আর কনকনে ঠান্ডার দাপট যেন ততই বাড়ছে। কখনো-কখনো তীব্র ঠান্ডা, ঘন কুয়াশা আর মৃদু শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে দৃষ্টিসীমা কমে আসা আচ্ছাদিত বিপর্যস্ত প্রকৃতির দেখা মিলছে রংপুরসহ পুরো উত্তরাঞ্চলে। এমন হাড়কাঁপানো শীতে উষ্ণতার জন্য গরম কাপড়ের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষের হাহাকারও।

এমন বৈরী আবহাওয়ার কারণে গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে নিউমোনিয়া, সর্দি, জ্বর, কাশিসহ ঠান্ডাজনিত নানান রোগ। খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও ঘটছে অগ্নিদগ্ধের ঘটনা। দগ্ধ হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে একজন মারাও গেছেন।

হিমালয়ের কোলঘেঁষা এই জনপদের শীতার্ত মানুষের চাহিদার বিপরীতে মিলছে না পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র। এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত সরকারি তরফ থেকে প্রায় তিন লাখ কম্বল মিলেছে। যা চাহিদার তুলনায় একেবারে নগণ্য। সরকারি-বেসরকারিভাবে সমাজের অসহায়, দুস্থ, গরীব ও ছিন্নমূল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছে সচেতনমহল।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণে কমেছে।

গত মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে  পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ১০ দশমিক নয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন গাইবান্ধায় সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

বুধবার (১ জানুয়ারি) এই অঞ্চলের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে দিনাজপুরে ১০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রংপুর এবং নীলফামারীর ডিমলায় ১২ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরদিন বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন ৮ দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

শনিবার (৪ জানুয়ারি) পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া, ঠাকুরগাঁওয়ে ১০ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস, লালমনিরহাট ও নীলফামারীর ডিমলা এবং সৈয়দপুরে ১২ দশমিক শূন্য, দিনাজপুরে ১২ দশমিক এক, রংপুরে ১২ দশমিক পাঁচ, গাইবান্ধায় ১২ দশমিক সাত এবং কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ১৩ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, বাতাসের আদ্রতা কাছাকাছি হওয়ায় বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হতে না পারায় সূর্যের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে সেটাও উত্তাপবিহীন। সঙ্গে ঝড়ছে শীত, আছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা। এই অঞ্চলে তাপমাত্রা অনেক স্থানে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসবে।

তিনি আরও বলেন, আগামী ৯ জানুয়ারি থেকে তাপমাত্রা আবার কমবে। এ সময় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামবে। আবহাওয়ার এই কঠিন পরিস্থিতি পুরো ফেব্রুয়াসি মাস থাকতে পারে।

উষ্ণতার জন্য আকুতি

এবার জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই এই অঞ্চলে শীত জেঁকে বসেছে জোঁকের মতো। যেন মরণ কামড় দিয়ে বসেছে। এখন শীত, কুয়াশা, বৃষ্টি ও শৈত্যপ্রবাহে কাহিল মানুষজনসহ জীবজন্তু। এই অঞ্চলে শীতের প্রকোপ এতটাই বেশি যে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। জনজীবনের স্বাভাবিক যাত্রায় পড়েছে ভাটা। গরু-ছাগলসহ গৃহপালিত পশুর অবস্থা একেবারেই কাহিল। কাজেকর্মে নেমে এসেছে স্থবিরতা।

কুড়িগ্রাম পৌর শহর এলাকার রাশেদ মিয়া নামে এক হোটেল শ্রমিক বলেন, কয়েক দিন থেকে কাজে যাই না। আজ রোদ উঠেছে। একটু শীত কম লাগছে। তাই কাজে এসেছি।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের পলাশবাড়ি এলাকার ভ্যানচালক আসাদুল ইসলাম বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া বেশি হচ্ছে। মানুষরা বাইরে বের হচ্ছে। এই আবহাওয়া থাকলে দুমুঠো ভাত খেতে পারবে।

কষ্ট প্রকাশ করে আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, মোটা গরম কাপড় কায়ো দিলে একনা কষ্ট কমিল হয়। কিন্তু কায় হামাক দেবে। এ্যলা তো নেতারা সগায় সগাকে নিয়া ব্যস্ত।

এদিকে কুয়াশায় ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। শ্রম বিক্রির অপেক্ষায় থাকা শ্রমিকেরা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তবে উষ্ণতার জন্য প্রয়োজনীয় মোটা কাপড়ের অভাবে শীতের ধকলে নাকাল তারা।

পঞ্চগড়ে হাড় কাঁপাচ্ছে শৈত্যপ্রবাহের কনকনে শীত

রংপুর নগরের শাপলা চত্বর, পায়রা চত্বর, বেতপট্টি মোড়, পার্কের মোড় ও টার্মিনাল এলাকায় শ্রমিকদের জটলা দেখা গেছে। খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে এসব হতদরিদ্র মানুষ। শহর-গ্রামে রাস্তায় থাকা ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলোর কষ্টও বেড়ে গেছে।

শাপলা চত্বরে শ্রম বিক্রি করতে আসা মহুবার রহমান বলেন, হামরা গরিব মানুষ, ঠান্ডা হোক আর গরমে হোক কাম করিবার লাগবেই। একদিন কাম না করলেও খামো কী? কায় হামাক খাবার দেবো। ঠান্ডা বাতাসোত কষ্ট তো হওচে। কিন্তু কিছুই করার নাই। কোনোটে কামের খোঁজ আসলে যাওয়া লাগবেই। হামরা ঠান্ডাত মরি যাওছি, সরকারের লোকেরা খোঁজ নেয় না।

শুধু দিনমজুরেরা নয়, তীব্র শীতে কাতর হয়ে পড়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে হতদরিদ্র মানুষ। সূর্যের দেখা মিললেও ঠান্ডা বাতাসে হারিয়ে গেছে উষ্ণতা।

বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা

প্রচণ্ড শীতের কারণে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী এই অঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, জেলা ও উপজেলা সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকেই ভর্তিও হচ্ছেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোহাম্মদ আব্দুল হাকিম জানান, প্রতিদিনই সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, বাতজ্বর, আমাশয়সহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছে। বেশি আক্রান্ত শিশুদের ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমান জানান, ঠান্ডার প্রকোপ বেশি হওয়ায় হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধর সংখ্যা বেশি। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, হৃদরোগ, অ্যাজমা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন।

আগুনে উষ্ণতা খুঁজতে গিয়ে বাড়ছে দগ্ধ রোগী

শীত থেকে বাঁচতে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানকার বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. এমএ হামিদ পলাশ জানান, শীত নিবারণের জন্য আগুন পোহাতে গিয়ে ১ ডিসেম্বর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে পাঁচজন। এর মধ্যে মারা গেছেন একজন। এ ছাড়া ৫০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন।

চাহিদা পূরণে হিমশিম, শীতার্তদের হাহাকার

জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে হতদরিদ্র ও দুস্থ মানুষের সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি। শীতের শুরুতে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে উত্তরের ১৬ জেলা থেকে ১৩ লাখ শীতবস্ত্রের চাহিদা দেওয়া হয় ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এখন প্রায় তিন লাখ কম্বল বরাদ্দ এসেছে।

বেসরকারি উদ্যোগেও সেভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক কমিটি কিছু কিছু জায়গায় কম্বল বিতরণ করছে। কিন্তু সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া কম্বল চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য।

একটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সরকারি হিসেবেই এই অঞ্চলে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০ লাখ। যাদেরকে সরকার ভিজিএফ-ভিজিডিসহ সরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির নানা প্রকল্পের মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকে। আর বেসরকারি হিসেবে উত্তরের ১৬ জেলায় সাড়ে ৮ হাজার বস্তিসহ প্রায় এককোটি অতিদরিদ্র মানুষ বসবাস করে। সে হিসেবে এই অঞ্চলে সরকারের বরাদ্দ দেওয়া কম্বল চাহিদার ২৫ ভাগ মাত্র।

রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, ইতোমধ্যেই সরকারিভাবে ১০ হাজার কম্বল জেলার সব উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়নে বিতরণ করা হয়েছে। আরও কম্বল চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

শীতার্তদের পাশে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুল বলেন, নভেম্বর মাসেই ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে রংপুর বিভাগের জন্য ৬ লাখ তিন হাজার কম্বলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত এক লাখের বেশি কিছু বেশি কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সেগুলো এখন বিতরণ কার্যক্রম চলছে।

এই সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: সিসা হোস্ট