জানা গেছে, ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেন নিলাম ছাড়াই সরাসরি ওই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। দুদকের চোখে এমন প্রক্রিয়ার যথেষ্ট অসঙ্গতি মনে হলেও, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে জনস্বার্থে বুক ভ্যালু পদ্ধতিতে ৪৪৮টি গরু জবাই ও মাংস বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
অথচ সরকারি যে কোনো সম্পদ বা পণ্য বিক্রয় কিংবা বিতরণে অবশ্যই দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণে বাধ্যবাধকতা রয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে পৃথক একটি টিম খামারবাড়ি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ২০২১ সালে জব্দকৃত নিষিদ্ধ ১৫ ব্রাহমা গরু পরিপালন-জবাই দেওয়া পর্যন্ত কোন কোন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছেন এবং কার কার দায়িত্ব অবহেলা ছিল তা খতিয়ে দেখা।
অভিযানকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হকসহ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেয় টিম। যদিও সন্তোষজনক বক্তব্য পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবারের (৪ জুলাই) অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, আজকের বিষয়টি মূলত অভিযান বলা যায় না। বলতে পারেন প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য কিংবা সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্য দুদক টিম গিয়েছিল।
অন্যদিকে এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সার্বিক পর্যবেক্ষণে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা পাওয়া গেছে। দুদকের অনুসন্ধানে সুলভ মূল্যে মাংস বিক্রির উদ্দেশ্যে চলতি বছরের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার থেকে আমদানি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদন নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুসহ বিভিন্ন জাতের ৪৪৮টি গরু জবাই দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া অসঙ্গতি ও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।
যার মধ্যে রয়েছে ব্রাহমা গরু জবাই না করে অন্য জাতের গরু জবাই করা, পরবর্তীতে কোরবানী ঈদে চড়া দামে বিক্রি করা, নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরুর সিমিন বিক্রি করা ইত্যাদি। আজ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে পারেন নাই। দুদক টিম বক্তব্য ও নথিপত্র যাচাই-বাচাই শেষ আইনী পদক্ষেপে দুই সরকারি অফিসের ডজন কর্মকর্তা মামলার আসামি হতে পারেন।
দুদক টিম কেন প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরে এসেছিল জানতে চাইলে অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. পল্লব কুমার দত্ত বলেন, দুদকের একটি টিম আজ (বৃহস্পতিবার) এসেছিল। তারা ব্রাহমা গরুসহ সংশ্লিষ্ট গরু বিতরণের নথিপত্র সংগ্রহ করতে এসেছিল। তারা কাগজপত্র নিয়ে গেছে।
অন্যদিকে ৪৪৮টি গরু নিলামে না দিয়ে কেন বুক ভ্যালু পদ্ধতিতে ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন তথা সাদিক অ্যাগ্রোকে দেওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মলয় কুমার শূর বলেন, আসলে জনস্বার্থে চাইলে বুক ভ্যালু পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। এখানে আইনের ব্যত্যয় হয় না। ৪৪৮টি গরু বুকভ্যালু পদ্ধতি মূলত ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনকে দেওয়া হয়েছিল। সাদিক অ্যাগ্রোকে নয়। বিস্তারিত ডিজি সাহেব বলতে পারবেন, কারণ দুদক টিম যখন এসেছিল তখন আমি অফিসে ছিলাম না।
বুক ভ্যালু কি?
বইয়ের ভাষায় Book Value বা হিসাবমতো মূল্য বলতে একটি কোম্পানি এর সব সম্পদ বিক্রয় করে দিলে এবং সব দায় পরিশোধ করে দিলে কোম্পানিটির সর্বমোট মূল্য যত হতে পারে সেই মূল্যকে বোঝায়। সহজ ভাষায় বুক ভ্যালু মানে একটি পণ্যের হিসাব করে নির্দিষ্ট দাম ধরে দেওয়া। যেমন- ওই সময়ে ৪৪৮ লাইভ গরুর মাংস কেজি প্রতি মূল্য ধরা হয়েছিল ভ্যাটসহ ৩২০ টাকা।
এর আগে বুধবার দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি টিম দ্বিতীয় দফায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদিক এগ্রোর ভিন্ন এক ঠিকানায় অভিযান চালিয়ে ছয়টি ব্রাহামা জাতের গরুর সন্ধান পায়। গরুগুলো জব্দ করে দেখভালো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারকে। সরকারি কাগজে কলমে এই গরুগুলো জবাই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমরা সাদিক এগ্রোর ফার্মে জীবিত পাওয়া যায়। গরুগুলো প্রাণি সম্পদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
ওইদিন আবুল কালাম আজাদে গণমাধ্যমকে বলেন, আপাতত মনে হচ্ছে, জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে কমিশনের বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। এরপর কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
দুদক ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা সেই সাদিক এগ্রোর নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি, বেআইনীভাবে প্রজনন, লালন-পালন এবং গরুগুলোর সিমেন (বীজ) বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির তথ্য পাওয়া যায়। বেশি দামে শত শত সিমেন বিক্রি ও বাছুর বিক্রি করে দেশব্যাপী নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু ছড়িয়ে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। অথচ ২০২১ সালে তিন বছর আগে জব্দ হওয়ার পর ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এসব গরুর কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো এবং প্রজনন কেন্দ্র থেকে সিমেন সাদিক এগ্রোতে গেলো সেটাই বড় প্রশ্ন?
অন্যদিকে চলতি বছরের রমযানে ১৫টি ব্রাহমা জাতের গরুসহ ৪৪৮টি গবাদিপশু জবাই করে ৬০০ টাকা কেজি দরে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি করতে ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনকে নিলামের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল। এই অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ ও প্রতারণার মাধ্যমে ব্রাহমা জাতের গরুগুলো তার খামারে নিয়ে যায়, যা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। গত তিন বছর ধরে ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে ছিল। এ অবস্থায় সেখান থেকে কীভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এসব গরুর কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো হলো এবং সিমন সাদিক এগ্রোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তা বিক্রি করা লাখ লাখ টাকা হাতানো হয়েছে তা তদন্ত করে করে বের করা হবে। কারন দুদকের অনুসন্ধানে সিমন বিক্রির তালিকা পাওয়া গেছে, যা জব্দ তালিকার মধ্যে রয়েছে। একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট পর্দার আড়ালে এখানে কাজ করেছে। অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে সোমবার প্রথম অভিযানে সাদিক এগ্রোর মোহাম্মপুর খামারে ব্রাহমা জাতের গরুর সাতটি বাছুরের সন্ধানও পায়। এ ছাড়া অভিযানে এ জাতের পাঁচটি গরুতে কৃত্রিম প্রজননের জন্য বীজ (সিমেন) দেওয়ার রেকর্ডপত্র পাওয়া পেয়েছে। ২০২১ সালে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৮টি গরু আমদানি করেছিল এই সাদিক অ্যাগ্রোই। কাস্টমস বিভাগ বিমানবন্দরে সেই গরু জব্দ করে। পরবর্তিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গরুগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়। কিন্তু সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গরুগুলো কৌশলে সাদিক এগ্রোকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠেছে।
সাদিক এগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ব্রাহমা জাতের ওই গরুগুলো দেশে আনার অভিযোগ রয়েছে। শাহীওয়াল জাতের নাম দিয়ে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮টি ব্রাহমা জাতের গরু জাল কাগজপত্র তৈরি করে দেশে আনেন তিনি। ২০১৬ সালে সরকার ব্রাহমা জাতের গরু বাংলাদেশে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
আমদানি নিষিদ্ধ উন্নত জাতের ওই গরুগুলো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জব্দ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। একটি গরু তখনি মারা যায়। অন্য গরুগুলো পাঠানো হয় সাভারের গো প্রজনন কেন্দ্রে। সেখানে আরও দুটি মারা যায়। পরে গরু আমদানি নিয়ে ওই বছরের ২০২১ সালের হাইকোর্টেও শুনানি হয়েছিল, তখন আদালত কাস্টমস কর্মকর্তাদের গরুগুলো জব্দ করার সিদ্ধান্তের পক্ষেই রায় দেন। এরপর ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গরুগুলো সাভারের গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারেই লালন পালন হয়।
আলোচিত ছাগলকাণ্ডে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ছাগলটি সাদিক অ্যাগ্রো থেকে কিনে এক লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেছিলেন। পরবর্তীতে এ নিয়ে যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে ছাগলটি আর ওই খামার থেকে নেওয়া হয়নি। এ ঘটনার পর সাদিক অ্যাগ্রোকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে অবৈধভাগে খাল ও সিটি করপোরেশনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা সাদিক অ্যাগ্রোর খামার ভেঙে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
Leave a Reply