সহিংসতা-হিংস্রতা শ্রমজীবী নারীদের আরও বেশি তাড়া করে। পুরুষতান্ত্রিক প্রতাপ আজও গিলে চলে নারী শ্রমিকদের। শ্রম চুরি হয়। পারিশ্রমিকদের শর্ত অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল। পুরুষের ন্যায় কর্মঘণ্টা, সমপরিমাণ কাজেও সমান মজুরি নেই।
গামের্ন্টস, কৃষি, গৃহ, দিনমজুরে ব্যাপক নারী শ্রমিক থাকলেও সর্বক্ষেত্রে নেই নিরাপত্তা, সম্মানও। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছনা সহ্য করাই যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। আজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা সচরাচর মে দিবস নামে অভিহিত। প্রতি বছরই ক্যালেন্ডার ধরে দিনটি আসে, চলেও যায়। ন্যায্য মজুরি-নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।
কৃষি এবং পারিবারিক গৃহশ্রমে নারী শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখের উপরে। এ সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু স্বীকৃতি মিলছে না। মজুরি বৈষম্য পদে পদেই। এ দুই খাতে সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত হয় নারী শ্রমিকরা। এক স্বীকৃতি নেই-দ্বিতীয় কাজের নিশ্চয়তা নেই। কখনো তাদের বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কখনো চলে মধ্যযুগীয় বর্বরতাও। ধর্ষণ নির্যাতন থেকে শুরু করে হত্যার শিকারও হচ্ছেন অসহায় নারীরা।
এ ছাড়া গার্মেন্টস শিল্পে ২৮ লাখের উপরে নারী শ্রমিক রয়েছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে তাদের মজুরি দাঁড়াতে পাচ্ছে না। সারা দেশে ১৭৭টি চা বাগান আছে। এর শ্রমিকের মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী। তাদের বাসস্থান থেকে শুরু করে খাদ্য-মজুরিতে বৈষম্য আরও বেশি। অধিকাংশ নারী শ্রমিকের সঙ্গে ক্রীতদাসের ন্যায় ব্যবহার করা হয়। দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হয়।
শ্রমজীবী নারী নেত্রীদের ভাষ্য, কিছু নারী নিজ নিজ যোগ্যতায় এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগের অধিকার ন্যায্যতা তলানিতে। নির্যাতন সহিংতার থাবা তো আছেই। মানুষকে অধিকার দেয় রাষ্ট্র। কিন্তু মহিলাদের অধিকারের ছাড়পত্র আদায় করতে হয় পরিবার ও সমাজের কাছে। পরিবারে চাকরির প্রশ্নে ছেলেরা এগিয়ে। সামাজিক ধারণা অনুযায়ী, মেয়েরা বেকার হয় না, অবিবাহিত হয়।
পরিবারে পরিশ্রমে সঞ্চিত অর্থ তাদের বিয়েতে ব্যয় করা হয়। কিন্তু তা দিয়ে তাদের পছন্দ মতো ব্যবসায় নিয়োগ করার উদ্যোগ নেই কিংবা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। বিয়ের পর পরিবারে যাবতীয় কাজের দায় এক গৃহবধূর মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়। তার পরিশ্রমের সময়ের কোনো হিসাব থাকে না, মূল্য থাকে না।
শ্রমজীবী একাধিক নারী জানান, তারা ঘরের বাইরে কাজ করার জন্য ‘অনুমোদন’ পেলে, সেখানেও জরুরি শর্ত থাকে। কর্মক্ষেত্র থেকে সোজা বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে রাতের রান্না এবং বাচ্চাদের দেখভাল করতে হবে। পরের দিন বাচ্চা-সংসার সামলে কাজে যেতে হবে। বেতনভাতা কিংবা মজুরি, তাও খরচের স্বাধীনতা থাকে না। স্বামী কিংবা পরিবার সদস্যদের ইঞ্চি ইঞ্চি হিসাব দিতে হয়।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাড়ি বাড়ি কাজ করেন রহিমা বেগম। ক্ষোভ উগরে বললেন, তিন কাজে সাত হাজার টাকা পান। পুরো টাকা ভ্যানচালক স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। সংসারে চার সন্তান। তার আয়ের হিসাব নেওয়া যায় না। পান, সিগারেট কিংবা নেশায় টাকা খরচ করে। উনিশ থেকে বিশ হলেই চলে নির্যাতন।
করোনায় কারখানার চাকরি হারিয়ে ফুটপাতে সবজির ব্যবসা করতেন খোদেজা বেগম। এখন রাজধানীর নতুন বাজার এলাকায় ইট ভাঙেন। মজুরি হিসাবে প্রতিদিন ৪০০ টাকা পাচ্ছেন। সমপরিমাণ কাজ করে পুরুষ শ্রমিক পাচ্ছেন এক হাজার টাকা। রংপুরের শামীমা আক্তার গার্মেন্টেসে কাজ করেছেন বহু বছর। জানালেন, ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। তার নাকি বয়স হয়ে গেছে, তাই বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন কী করেন? মানুষের কাছ থেকে সাহায্য তুলে খাই।
কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতক থেকে কোটিতে পৌঁছেছে। কিন্তু স্বীকৃতি নেই শ্রমের। আবার মজুরির ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য। স্বাধীনতার পর কৃষিতে এখন এক কোটির বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা এক কোটির বেশি। নারী নেত্রীদের ধারণা-গত ৫ বছরে এ সংখ্যায় ন্যূনতম আর ১০ লাখ কৃষি নারী শ্রমিক বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তথ্যানুযায়ী, নারী কর্মজীবীদের মধ্যে কৃষিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী যুক্ত।
বিজিএমইএ’র সহসভাপতি সহিদুল্লাহ আজিম জানান, গার্মেন্টস শিল্পের ৭০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। তাদের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। বিভিন্ন গার্মেন্টসে এখন অটোমেটিক মেশিন ব্যবহৃত হওয়ায় নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে।
আইএলও কনভেনশনে দৈনিক ৮ কর্মঘণ্টার কথা নির্ধারিত থাকলেও বাংলাদেশে তা মানা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর পরিচালক কহিনূর মাহমুদ। তিনি জানান, গৃহশ্রমিক কিংবা যেকোনো নারী শ্রমিক ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত। ৮০ শতাংশের বেশি শ্রমিক মে দিবস ও স্বাভাবিক সরকারি ছুটির দিন কাজ করেন। গৃহশ্রমিকের ৯০ শতাংশই নারী। তাদের ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন। কখনো হত্যারও শিকার হন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম সভাপতি মোশরেফা মিশু জানান, বর্তমানে শ্রমজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষের হাতে নেই। এতে অসহায় শ্রমিক শোষক সমাজের নিষ্ঠুর পীড়নে নিঃশেষিত হচ্ছে। নারী শ্রমিকরা উন্নত জীবন, বাসস্থান, উন্নত কর্মপরিবেশ কখনো পান না। তাদের শোষণ করা হচ্ছে। বেতন ন্যূনতম ২৫ হাজার করা জরুরি। ৮ ঘণ্টা শ্রম নিশ্চিত করতে হবে-তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারেরও।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানান, প্রত্যন্ত গ্রামেও নারীরা বিভিন্ন শ্রমে যুক্ত হচ্ছেন। তাদের ন্যায্য মজুরি-কর্মঘণ্টার বালাই নেই। অধিকার বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগও নেই। ডিজিপিতে নারীশ্রম এগিয়ে। কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ মালিকপক্ষ তাদের অধিকারবঞ্চিত করছে। ন্যায্য মজুরি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
Leave a Reply