ধসে পড়া টানেলের ধ্বংসস্তূপের নিচে ১৬ দিন ধরে আটকা ৪১ শ্রমিককে উদ্ধারের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। উদ্ধার তৎপরতায় বিভিন্ন ধরনের বিপত্তির পর মঙ্গলবার টানেলে শ্রমিকদের অবস্থানের কাছাকাছি ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে পাইপ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করেছেন উদ্ধারকারীরা। মঙ্গলবার ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টানেলে আটকা শ্রমিকদের উদ্ধারের বিষয়ে এই তথ্য জানিয়েছে। তারা বলেছেন, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টানেল থেকে একের পর এক শ্রমিককে উদ্ধার করা হবে।
পাথর কেটে তৈরি করা পথ দিয়ে শ্রমিকদের বের করে আনার পর নিরাপদে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সকে পরীক্ষামূলকভাবে টানেলের মুখে পাঠানো হয়েছিল। এর মাধ্যমে টানেলে আটকা শ্রমিকদের কাছে কতদূর পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স যেতে পারবে তা পরীক্ষা করা হয়। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ৫৫ মিটারেরও বেশি খনন করেছেন। উদ্ধারের অপেক্ষায় থাকা শ্রমিকদের থেকে আর মাত্র কয়েক মিটার দূরে রয়েছেন টানেলের গায়ে খননকারীরা।
গত ১২ নভেম্বর ভোরে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় হিমালয় ঘেঁষা রাজ্য উত্তরাখণ্ডের একটি নির্মাণাধীন টানেল ধসে পড়ে। এর ফলে টানেলের মুখ থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার দূরের একটি জায়গায় ৪১ জন পুরুষ শ্রমিক আটকা পড়েন। তারা সবাই স্বল্প বেতনের নির্মাণ শ্রমিক। বেশিরভাগ শ্রমিকই উত্তর ও পূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দা। তবে তাদের মধ্যে অন্তত দুজন উত্তরাখণ্ডের স্থানীয় বাসিন্দা বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উচ্চাভিলাষী চরধাম তীর্থযাত্রা প্রকল্পের আওতায় উত্তরাখণ্ডে সিল্কিয়ারা বেন্ড-বারকোট টানেল নামের এই টানেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। টানেলটি সিল্কিয়ারা ও দান্দলগাঁওয়ের চারটি উল্লেখযোগ্য হিন্দু তীর্থস্থানকে সংযুক্ত করেছে। প্রায় দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে দ্বিমুখী রাস্তার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ এখনও টানেল ধসের কারণ জানায়নি। তবে ওই অঞ্চলটি ভূমিধস, ভূমিকম্প এবং বন্যার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সি পি রাজেন্দ্র কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হিমালয় ভূখণ্ডে অত্যন্ত ভঙ্গুর শিলা রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত সেখানে শিলার অবস্থান পরিবর্তন অর্থাৎ সরে যেতে দেখা যায়।
তিনি বলেন, ‘‘এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। একই ধরনের ভূখণ্ডে রাস্তা কিংবা টানেল নির্মাণের সময় আমরা ক্রমাগত দুর্যোগের পর বিপর্যয় ঘটতে দেখেছি।’’
ধ্বংসাবশেষ খনন করার পর টানেলে একটি ছোট পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এই পাইপলানের মাধ্যমে সুড়ঙ্গে আটকা শ্রমিকদের কাছে খাবার, পানি, অক্সিজেন, ওষুধ, লাইট এবং ওয়াকি-টকি পাঠানো হয়। শুকনো ফল, মুড়ি, ছোলা এবং বাদামও পাঠানো হয়েছে।
গত সপ্তাহে টানেলে একটি নতুন প্রশস্ত পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে চাল, মসুর ডাল, সয়াবিন এবং মটরদানায় রান্না করা খাবার শ্রমিকদের কাছে পাঠানো হয়।
শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগকারী চিকিৎসক প্রেম পোখরিয়াল ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, তারা চর্বণযোগ্য ভিটামিন সি ট্যাবলেটের দাবি করেছিলেন এবং আমরা তা সরবরাহ করেছি। এখন পর্যন্ত সবাই সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছেন বলে মনে হচ্ছে।
টানেলের কাছে একটি ছয় শয্যার অস্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া টানেলের আশপাশের সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে টানেল এলাকায় ১৫ জন চিকিৎসক ও ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন রয়েছে। শ্রমিকদের উদ্ধারের পর প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা দেবেন চিকিৎসকরা। এরপর তাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়া হবে।
আটকা পড়া কয়েকজন শ্রমিক মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব এবং আমাশয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন। পরে তাদের কাছে ওষুধ পাঠানো হয়। উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকারের টানেল এলাকায় পাঠানো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অভিষেক শর্মা ৪১ শ্রমিকের সাথে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে কথা বলেছেন। এ সময় তিনি টানেলের ভেতরের যে এলাকায় শ্রমিকরা অবস্থান করছেন, তার ২ কিলোমিটারের মধ্যে হাঁটাহাটি, পর্যাপ্ত ঘুম, হালকা যোগ ব্যায়াম এবং নিজেদের মধ্যে নিয়মিত কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গত বুধবার থেকে একজন হিন্দু পুরোহিত টানেলের মুখের কাছে বসে শ্রমিকদের জন্য প্রার্থনা করে আসছেন।
গত সোমবার নতুন স্থাপিত প্রশস্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে সুড়ঙ্গের ভেতরে একটি মেডিকেল এন্ডোস্কোপিক ক্যামেরা ঢোকানো হয়েছিল। গত সপ্তাহে ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই ভিডিওতে আটকা পড়া শ্রমিকদের প্রথমবারের মতো দেখা যায় এবং তাদের সঙ্গে কথা বলেন উদ্ধারকারী দলের কর্মকর্তা ও চিকিৎসকরা।
টানেলের মুখে একজন উদ্ধারকর্মী পাইপলাইন থেকে ক্যামেরাটি হাতে তুলে নিতে বলেন এক শ্রমিককে। আটকা শ্রমিকদের সবার চেহারা যেন ভিডিও করেন, সেই নির্দেশও দেওয়া হয় ওয়াকি-টকির মাধ্যমে। পরে শ্রমিকরা ক্যামেরার সামনে এসে তাদের নিজেদের পরিচয় এবং সুস্থ আছেন বলে জানান।
ভারতের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এনডিআরএফ) ১৫ সদস্যের একটি দল টানেলে আটকা শ্রমিকদের উদ্ধার অভিযানের দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া প্রায় ৮০ পুলিশ সদস্য, ফায়ার সার্ভিসের ২০ কর্মকর্তা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তরের ৬০ কর্মকর্তা উদ্ধারকাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা অত্যাধুনিক খনন যন্ত্র ব্যবহার করে ধ্বংসাবশেষের মাঝ বরাবর শ্রমিকদের উদ্ধারের পথ তৈরি করছেন। খনন করা পথে স্টিলের প্রশস্ত পাইপ ঢুকানে হচ্ছে। শ্রমিকদের টানেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ হিসাবে কাজ করবে এই পাইপ। টানেলটি ধসে পড়ার প্রায় তিন দিন পর সেখানে ভারী যন্ত্রপাতি মোতায়েন করা হয়েছিল।
পরে অনেকটা আকস্মিকভাবে বিশাল আকারের একটি পাথর খনন কাজে নিয়োজিত মেশিনের ওপর পড়ে। ফলে দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে আরও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়। এই অভিযানে উদ্ধারকারী দলের জন্য এটিই একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিল না। বরং বোল্ডার, সিমেন্টের শিলা এবং লোহার রডের মতো অন্যান্য আলগা বস্তুর ধ্বংসাবশেষও টানেলে পড়ে যায়।
গত ১৭ নভেম্বর উদ্ধার অভিযানে বড় ধরনের বিপত্তি দেখা দেয়। ওই দিন একটি ড্রিলিং মেশিন খননের সময় অকেজো হয়ে পড়ে। পরে কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে টানেলে খনন অভিযান স্থগিত করে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা অগার মেশিনও পাথর কাটার সময় নষ্ট হয়ে যায় এবং এই মেশিনের বিয়ারিংগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টানেলে ধসের এক সপ্তাহ পর ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্য থেকে একটি নতুন মেশিন উড়িয়ে আনা হয়। একই সঙ্গে আনুভূমিক ড্রিলিংয়ের পাশাপাশি টানেলে খাঁড়াভাবেও ড্রিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেশিরভাগ ধ্বংসাবশেষ খনন করা হলেও গত বৃহস্পতিবার উদ্ধারকারীরা একটি স্টিলের জালি শিটের মুখোমুখি হন। পরে সেটি কাটতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়।
এই দুর্ঘটনার পর ভারতের জাতীয় মহাসড়ক কর্তৃপক্ষের (এনএইচএআই) তৈরি করা অন্য ২৯টি টানেলের নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশে ১২টি, জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে ছয়টি এবং উত্তরাখণ্ডসহ অন্যান্য রাজ্যের বাকি টানেলগুলোও রয়েছে।
সূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স।
Leave a Reply