রাজশাহীর সুনাম অনেক শুনেছি! আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর শহর ছিল রংপুর। স্মৃতির শহর। রাস্তার দুধারে টিনে ছাওয়া বাংলা ধরনের বাড়ি, প্রতিটা বাড়ির সামনে বাগান, দরজায় মাধবীলতার ঝাড়; বাগানে পাতাবাহারের গুচ্ছ দিয়ে লেখা বাড়ির নাম, চামেলিবাগ, ছায়াবীথি, আর প্রতিটা বাড়ি ছিল নানা রঙে বর্ণদার। সেই রংপুর আর নেই। দূর থেকে রাজশাহীর সুনাম শুনেছি। এইটাই নাকি দেশের সবচেয়ে সুন্দর শহর!
গত ৫ আর ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাজশাহীর মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য হলো। চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জনও হলো। এখন, নিজের চোখে দেখে এসে বলতে পারি, রাজশাহী হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর শহর।
রাজপথগুলো ঝকঝক করছে। একটা কাগজের টুকরা কোনো রাস্তায় পড়ে নেই। আমাদের গাড়িতে করে ঘোরালেন আরাফাত রুবেল। তিনি নিজেই একটা উপন্যাসের চরিত্র। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে। এখনো দেশে-বিদেশের প্রদর্শনীতে নিজের আঁকা ছবি পাঠান। কিন্তু এখন তিনি একজন অভিনব উদ্যোক্তা। তাঁর ফেসবুক পেজে সওদাগর অ্যাগ্রোতে ঢুকলে আপনি দেখবেন, গরুকে তিনি বাঁশি বাজিয়ে শোনাচ্ছেন। না। ভুল পড়েননি। তিনি নিজে বাঁশি বাজাচ্ছেন। আর তা শুনছে একটা গরু। তিনি গরুর প্রজাতি উন্নয়ন করেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু আবাদ করেন। আর গোখাদ্য উৎপাদন ও বিপণন করেন। এই সৃজন-উন্মাদ আম দিয়ে জিলাপি আর মিষ্টি বানিয়েছিলেন। এমন বিক্রি হওয়া শুরু হয়েছিল যে দেশের প্রতাপশালীরা পর্যন্ত তাঁর কাছে এক রাতে মণকে মণ আমের জিলাপির অর্ডার দিতে শুরু করল। তিনি ভাবলেন, যথেষ্ট হয়েছে। আর না।
এই আরাফাত রুবেল নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন। আর আমাদের রাজশাহীর রাস্তাঘাট, বিভিন্ন এলাকা দেখাচ্ছেন। তিনি জানালেন, সিটি করপোরেশন বাড়ি বাড়ি বিন দিয়ে এসেছে। সবাই বিনে ময়লা ফেলেন। সেই ময়লা সংগ্রহ করে নিয়ে যায় সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। প্রতিদিন দুই বেলা করে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া হয়।
ফলে নগরবাসীও এখন কেউ রাস্তায় ময়লা ফেলেন না। বেশির ভাগ রাস্তার মধ্যে সড়ক বিভাজক। খুবই সুন্দর নকশা সেসবের। আর সেই বিভাজকে সুন্দর সুন্দর গাছ। পাম ট্রি আছে, পাতাবাহার আছে, আছে ফুলের গাছও। সড়ক বিভাজক ধরে সারি সারি আলোকস্তম্ভ। বিভিন্ন শৌখিন বাতি ঝুলছে রাস্তায়। পথের দুধারের দেয়ালগুলোতে চমৎকার নকশা আঁকা। এমন পরিপাটি রাস্তা কি আর কোনো শহরে আছে?
আমরা ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় গেলাম পদ্মা নদীর পার। তালাইমারীর এই জায়গাটা একাত্তরের শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত। এটা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বধ্যভূমি। এখানেই প্রথম আলো ট্রাস্টের আলোর পাঠশালা। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল। এই স্কুলের মাঠেও এক টুকরা কাগজ বা ময়লা পড়ে নেই। রাজশাহীর প্রথম আলো প্রতিবেদক আবুল কালাম আজাদ নদীর ধারে স্কুলমাঠে বটগাছ পুঁতে দিয়েছেন। তাঁর আশা, গাছটা বড় হলে শিক্ষার্থীরা প্রাণভরে গাইবে, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে।
২০১৬ সালে বিলাতের কাগজ গার্ডিয়ান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। কীভাবে রাজশাহী শহর বায়ুদূষণ কমিয়ে ফেলতে পেরেছে। শহরে কোনো খোলা ধুলার জায়গা থাকবে না। সড়ক দ্বীপ ও বিভাজকগুলো গাছে ও ঘাসে ঢাকা। রাজশাহী শহরের রাস্তায় ধুলা বা কাগজ পড়ে নেই। তবে বায়ুদূষণ কিন্তু আবারও বেড়ে গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারিতে বায়ুদূষণের সূচক ১৬১। পিএম ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সীমার ১৫.৫ গুণ। এর কারণ, আমার মনে হলো, অনেক রাস্তায় এখন মেরামতের কাজ চলছে। সেসব জায়গা থেকে ধুলো উড়ছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আবারও বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে।
আরেকটা সমস্যার কথা জানালেন স্থানীয় নাগরিকেরা। সুন্দর বাস টার্মিনাল বানানো হয়েছে। কিন্তু বাসগুলো টার্মিনাল ব্যবহার করতে চায় না। গাড়ি রাখে রাস্তার ওপরে।
রাজশাহীর উপশহর এলাকায় রাতের বেলা আমরা খেতে গেলাম কালাইয়ের রুটি। কালাই হাউস নামের একটা রেস্তোরাঁয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলারের ছবি দেখা গেল, তিনি এখানে নিজ হাতে রুটি বানাচ্ছেন তার ছবি টানানো আছে। হাঁসের মাংস, বট, বেগুন ভর্তা, মরিচ-পেঁয়াজ ভর্তা সহযোগে আমরা খেলাম স্পেশাল কালাইয়ের রুটি। রুটির দাম ত্রিশ টাকা। এই রাস্তায় এ রকম বেশ কটা ছাপড়া ধরনের রেস্তোরাঁ। রাস্তায় চেয়ার বিছিয়েও খাওয়া যায়।
কালাই-রুটির নৈশভোজ সেরে আমরা চললাম সিঅ্যান্ডবি এলাকায়। গরম-গরম রসগোল্লা খাব। সেখানে দেখা গেল বেশ ভিড়। সত্যি সত্যি গরম-গরম রসগোল্লা বিক্রি হচ্ছে। ভেবেছিলাম একটা খাব। কিন্তু একাই তিনটা বড় বড় মিষ্টি সাবাড় করে দিলাম। এই মিষ্টি এখানে দাঁড়িয়েই খাবেন। খাওয়ার পর যদি এটাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রসগোল্লা মনে না হয়, তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
রাজশাহী পুরোনো শহর। এখানে এখনো ঐতিহ্যবাহী ভবন আছে। ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্য রীতি আছে। যেমন রাজশাহী কলেজ কিংবা বরেন্দ্র একাডেমি। প্রথম আলোর জিপিএ শিক্ষার্থী সংবর্ধনা হলো ৬ ফেব্রুয়ারি, জিয়া পার্কে। ছেলেমেয়ে সব চৌকস। তাদের প্রশ্ন এবং উত্তর শুনে আমরা মুগ্ধ।
রাজশাহী শিক্ষার শহর। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এখানে। এটা চিকিৎসারও শহর। রেশমের এলাকা। আমের এলাকা। একটা শহর কীভাবে পরিষ্কার রাখা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছেন রাজশাহীবাসী। রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনও প্রশংসা পাবেন। তবে, বাতাসের ভাসমান কণা কীভাবে কমানো যায়, এই নিয়ে আবার আদাজল খেয়ে নামতে হবে সিটি করপোরেশনকে।
আমার বিবেচনায় রাজশাহীই বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর শহর। আগে চট্টগ্রামও খুব সুন্দর ছিল। চট্টগ্রামের সৌন্দর্য এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহীর ল্যান্ডস্কেপ এখনো সুন্দর রয়ে গেছে। আপনি কি আমার সঙ্গে একমত? আপনি নিজেই বাংলাদেশের সেরা ৫টা শহরের তালিকা করে ফেলুন না!
লেখক, আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক
Leave a Reply