প্রচন্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে দেশজুড়ে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। সকাল, দুপুর, বিকেল এমনকি মধ্যরাতেও হচ্ছে লোডশেডিং।
ফলে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে মানুষ। রাজধানীতে গড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে।
অন্যান্য বছরের চেয়ে চলতি বছর গরমের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে। গরম আর অসহনীয় তাপে যেন শরীর পুড়ে যাবার অবস্থা প্রায়।
ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন মানুষ। বিশেষ করে শিশু, নারী এবং বৃদ্ধরা তীব্র গরমে সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাতাসের আর্দ্রতা কমে বাতাস শুষ্ক হয়ে যাওয়ার ফলে সূর্যের তাপ শরীর থেকে পানি শুষে নিচ্ছে। ফলে আমাদের ত্বক জ্বালাপোড়া করছে। এরই মধ্যে গরম নিয়ে কোনো সুসংবাদ দিতে পারেনি তারা।
আবহাওয়া অধিদফতর পক্ষ থেকে জানা যায়, আগামী সপ্তাহেও এই তীব্র গরম অব্যাহত থাকবে। গত কয়েক দিনে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপদাহ রেকর্ড হয়েছ। আপাতত মুক্তি নেই এই গরম থেকে। বর্ষাবাহী মৌসুমি বায়ু এখনো প্রবেশ করেনি দেশে। মৌসুমী বায়ু প্রবেশের পর ক্রমশ তাপদাহ কমবে।
মঙ্গলবার (৬ জুন) দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল দিনাজপুর ও সৈয়দপুরে। আর ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল৩৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই গরমের সঙ্গে বাড়তি ভোগান্তির আরেক নাম লোডশেডিং। রাজধানীতে এলাকাভেদে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় মঙ্গলবার রাজধানীর শেওড়াপারা এলাকায় সকাল পৌনে ৮টা থেকে পৌনে ৯টা, বিকেলে সোয়া ৩টা থেকে সোয়া ৪টা এবং সাড়ে ৫টা থেকে ৬.৫০ মিনিট পর্যন্ত মোট তিন বার লোডশেডিং দেওয়া হয়। আবার মধ্যে রাতেও দেওয়া হচ্ছে লোডশেডিং।
এদিন বিকেলে শেওরাপাড়ার শামিম সরণি এলাকায় লোডশেডিং চলাকালীন দেখা যায়, তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে নারী-পুরুষ এবং শিশুরা বাসা থেকে বের হয়ে গলিতে, বাসার দরজার সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে এবং হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে কিছুটা স্বস্তির খোঁজ করছেন। তীব্র গরমে সর্বাধিক কষ্টের শিকার হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। গরমের তীব্রতা থেকে বাঁচতে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন গাছের তলায় কিংবা ছায়াযুক্ত স্থানে।
রাজধানীর দক্ষিণখানে দিনে দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে রাতেও দুই থেকে তিনবার লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বাংলামোটর, হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় দুপুর ২টা থেকে ৩টা, রাত ১০টা থেকে ১১টা, ৩টা থেকে ৪টা, ভোর ৬টা থেকে ৭টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। রাজধানীর অনান্য স্থানের চিত্রও প্রায় একই রকম।
লোডশেডিংয়ের বিষয়ে মো. এনামুল হক নামে একজন বলেন, এর আগে কোন দিন এমন কষ্ট হয়নি। রাতের বেলা বিদ্যুৎ চলে গেলে বাচ্চারা গরমে কান্না শুরু করে দেয়। বাচ্চাদের সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। এভাবেই প্রতিদিন চলছে। আমরাতো বিদ্যুতের টাকা বাকি রাখি না, তাহলে এই লোডশেডিংয়ের দায় কার?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও একজন ভুক্তভোগী বলেন, প্রকৃতি এবং সরকার উভয়েই আমাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে। এই গরমে বেঁচে থাকাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
তামজিদ হাসান নামে একজন ফেসবুকে লোডশেডিংয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, রাত ১টা ৩০ মিনিট শরীর দিয়ে উন্নয়নের ঝোল টপটপ করে পড়ছে…।
এদিকে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তীব্র গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়লেও জ্বালানিসংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে। ফলে দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু বিপিডিবির ঘাটতি হচ্ছে তিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেডেলপমেন্ট বোর্ডের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক শামিম হাসান বাংলানিউজকে জানান, মঙ্গলবার (৬ জুন) দুপুর ১২টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে উৎপাদন হয় ১২ হাজার ১৬৬ মেগাওয়াট। ফলে লোডশেডিং করতে হয়েছে দুই হাজার ৬১০ মেগাওয়াট।
এমন পরিস্থিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগও সহসাই কোনো ভালো খবর দিতে পারছে না দেশবাসীকে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে লোডশেডিং কমতে পারে বলে জানিয়েছে তারা।
লোডশেডিং বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী তার ফেসবুকে দেওয়া এক বার্তায় দেশবাসীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করে জানান, চলমান তাপদাহ ও লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। তবে শিগগিরই জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে আমরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করছি। আশা করছি, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে।
নসরুল হামিদ বলেন, লোডশেডিংয়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যা সবার জানা উচিত। কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে ভয়াবহ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা আপনারা সবাই জানেন। গ্যাস, কয়লা, ফার্নেস অয়েলসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে আকাশচুম্বী হয়েছে, এমনকি বাজারে এর প্রাপ্যতাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ডলারের বিনিময়হার লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস অয়েলের মতো জ্বালানি আমদানিতে প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে চলমান লোডশেডিং হচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে সরকার তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশের প্রতিটি ঘর বিদ্যুৎ–সুবিধার আওতায় এনেছে। দেশে বিদ্যুতের আগের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে নসরুল হামিদ বলেন, ২০০৮ সালে মাত্র ৪৪ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পেত, যা এখন শতভাগ।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, তখন দেশবাসী দিনে কমপক্ষে ১৬-১৮ ঘণ্টা লোডশেডিং ভোগ করেছে। বিদ্যুতের চাহিদার কথা মাথায় রেখে আমরা গত এক যুগে বিদ্যুতের উৎপাদন ৫ গুণের বেশি বাড়িয়েছি। বর্তমানে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ)। তবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসংকট এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারের ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে আমরা অপ্রত্যাশিত লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছি।
তিনি বলেন, আমি আপনাদের দুর্ভোগের জন্য দুঃখিত। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, চলমান পরিস্থিতি সাময়িক। আমরা খুব কম সময়ের মধ্যে একটি ভালো অবস্থানে ফিরে আসতে পারব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিভিন্ন স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আমি আশা করি, আপনাদের (দেশবাসী) আস্থা ও সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এই দুর্ভোগ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, একসঙ্গে আমরা লাঘব করতে সক্ষম হব।
Leave a Reply