দিন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ছিলেন রেজাউল করিম (৫০)। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবারও (২ ফেব্রুয়ারি) রাজমিস্ত্রির লেবার হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন রাজশাহী নগরীর সপুরায়। সকাল থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার চৈতন্যপুর গ্রামের মো. রাকিবুল ইসলাম হেডমিস্ত্রির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছিলেন। প্রতিদিনের মতো এদিনও তার চিন্তা ছিলো- ‘আজকের কাজের মজুরি পেলেই, পরিবারের মুখে ভাত জুটবে’। তার স্ত্রী-সন্তানরাও অপেক্ষায় ছিলেন, বাবার কাজ শেষে নিয়ে আসা চাল-ডালের। তবে সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো বাবা হারানোর খবরে!
রেজাউল চিন্তা ও কল্পনাতে হয়তো ভাবতেও পারেন নি বিকেল ৩ টার পর তাদের ওপর জঙ্গি কায়দায় নৃশংস নির্যাতন চালাবেন গৃহকর্তা। মজুরি তো দূরে থাক, চুরির অপবাদ দিয়ে অঝরে ঝরানো হবে রক্ত। যেই রক্তে ক্ষোভের তিষ্ণা মেটাবেন গৃহকর্তা। যে নির্যাতন জাহিলি যুগের বর্বরতাকেও হার মানাবে। তবুও এদের মন গলবে না।
তবে তারা যা কল্পনাতেও ভাবতে পারেন নি; তার চেয়েও নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছেন গৃহকর্তা সপুরার মডার্ন ফুডের মালিক আব্দুল মালেকের ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহসহ তার সহযোগীরা। চুরির অপবাদ নিয়ে রাকিবুলসহ রেজাউলকে রশি দিয়ে বেঁধে লোহার রড ও গাছের ডাল দিয়ে অমানবিক নির্যাতনের একপর্যায়ে পায়ের নখ একটি একটি করে উপড়িয়েছে এই হত্যাকারীরা। যে হত্যার বর্ণনা তারা পুলিশের কাছে দিয়েছে, তা চরমপন্থি জঙ্গি কায়দাকেও হার মানাবার মতো! পিটিয়ে হত্যার এই দৃশ্য হত্যাকারীদের একজন মুঠোফোনে ধারণও করেছে। যেটা এখন পুলিশ হেফাজতে আছে।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঘরের মধ্যে আটকিয়ে রেখে এই পাশাবিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে বিষয়টি টের পান প্রতিবেশীরা। রাত ৯ টার দিকে ফোন দেন ৯৯৯ নম্বরে। সেখান থেকে নগরীর বোয়ালিয়া থানাকে জানানো হলে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। সেখানেও রাকিবুল ও রেজাউলকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করতে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে এই হত্যাকারীরা। এসময় পুলিশ তাদের আটক করে এবং চিকিৎসার জন্য রাকিবুল ও রেজাউলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাকিবুলকে মৃত ঘোষণা করে। এর কিছুক্ষণ পর রেজাউলও শেষ নিশ^াস ত্যাগ করেন।
রেজাউলের স্ত্রী জানান, তিনি ও তার স্বামী সন্তানদের নিয়ে নগরীর ডাবতলা এলাকায় ভাড়া থাকেন। তাদের সম্বল বলতে ছিলো স্বামীর উপার্জন। একদিন কাজ না হলে, সেদিন সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারতেন না তারা। একারণে রেজাউল নিজে থেকে কখনো কাজ ফাঁকি দিতেন না। প্রতিদিনই তার স্বামী সন্ধ্যা ৭ টার আগে কাজ করে চাল-ডাল নিয়ে বাসায় ফিরতেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার অনেক রাত হয়ে গেলেও সে বাসায় আসছিলো না। যা নিয়ে টেনশনে ছিলেন তিনি। সন্তানরাও খাবারের জন্য ছটফট করছিলো। কারণ সে আসলে রান্না হবে। স্বামীর আসতে দেরি দেখে তার ছেলে ইকরামুলকে (১৬) খোঁজ নিতে পাঠান। রাতে সে সপুরায় খোঁজ নিতে গেলে এক পুলিশ সদস্য তাকে জানায় তার বাবা হাসপাতালে আহত অবস্থায় ভর্তি। তাৎক্ষণিক সে রাজশাহী মেডিকেলের জরুরি বিভাগে গিয়ে জানতে পারে, তার বাবা আর নেই।
রেজাউলের স্ত্রী আহাজারির মধ্যে বলছিলেন, তাদের নিঃস্ব করে দিয়ে ওই সন্ত্রাসীরা তার স্বামীকে কেড়ে নিয়ে চলে গেলো। এখন তাদের কী হবে? কে তার সন্তানদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিবে?
উল্লেখ্য, এ ঘটনায় রাকিবুল ইসলামের স্ত্রী মোসা. সুমা খাতুন চার জনের নামসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার সপুরা বিসিক এলাকার মো. আব্দুল মালেকের ছেলে আব্দুল্লাহ, এয়ারপোর্ট থানার বায়া বাড়ইপাড়ার মৃত মনির উদ্দিনের ছেলে মাসুম রেজা (৫০), মো. শফিকুল ইসলামের ছেলে মো. মঈন উদ্দিন রিয়াল (১৯) ও রাজপাড়া থানার সিলিন্দা বাগানপাড়ার মো. মোশারফের ছেলে মো. ইমরান (২১)।
Leave a Reply