থার্টি-ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি, পটকাবাজি ও ফানুস উড়িয়ে নতুন বছরের আগমনকে উদযাপন করা রীতিমতো সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে রাজধানীবাসী। প্রতি বছরের মতো এবারও তাই থার্টি-ফার্স্ট নাইট উদযাপন নিরাপদ পরিবেশে সম্পন্ন করতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং মশাল মিছিল নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার, শাঁখারিবাজার, রায়সাহেব বাজার এলাকায়সহ বিভিন্ন এলাকায় থার্টি-ফার্স্ট নাইটের আনন্দ উল্লাসের অংশ হিসেবে আতশবাজি ও পটকা বিক্রির এ তথ্য পাওয়া যায়।
এসব এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেআইনি বললেও স্পার্কলার, পটকা, আকাশ-রকেট, রঙিন বোমা এবং অন্যান্য আতশবাজির ব্যবসা চলছে। গোপনে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট গলিতে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দরদাম করে নির্দিষ্ট স্থানে ডেলিভারি দেওয়া হয়। তরুণরা ব্যস্ত ফানুস বেচাকেনা নিয়ে। প্রকাশ্যে ফানুস, আতশ ও পটকা বিক্রি করতে দেখা না গেলেও পরিচিত হলে অর্ডার করলেই মিলছে এসব পণ্য।
এর পাশাপাশি এখন অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আতশবাজি ও ফানুস পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ফায়ারওয়ার্কস বিডি, আতশবাজার.কম, বাজিরং, ফানুশ বাংলাদেশ, ফানুশ ঘর, স্টারফায়ারওয়ার্কস, ঢাকা ফায়ারওয়ার্কসের মতো ফেসবুক পেজ এবং অন্যান্য পেজ বিভিন্ন ছাড় ও অফার দিয়ে আতশবাজি বিক্রি করছে। এসব ফেসবুক পেজে দেখা যায়, যে কোনো ফানুস ও আতশবাজি অনলাইনে হোম ডেলিভারিতে বিক্রি করছে তারা। এতে দোকানে না গিয়েও অনেকে ফানুস কিনছেন। তাই প্রতি বছরের মতো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজার ও চকবাজারে বিভিন্ন প্রকারের আতশবাজি উৎপাদন হয়ে থাকে। এরসাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বেচাবিক্রি কমে গেছে। পুলিশের নিষেধজ্ঞা, মাঝে মাঝে অভিযান, প্রয়োজনে মামলাও দেওয়া হয়। তাই অনেকেই এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। যারা আছে তারা অনেক গোপনে বিক্রি করছেন। বর্তমানে আতশবাজি আমদানি করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ পুরো ব্যবসাই অবৈধ। দুর্গাপূজার আগে বন্ধু ও বাণিজ্য অংশীদাররা গোপনে কাপড় ও অন্যান্য পণ্যের চালানের মাধ্যমে এগুলো নিয়ে আসেন। এবারে পুরনো আতশবাজিই বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, শাঁখারিবাজার ও চকবাজারের ১৩০-১৫০টি দোকান সারা দেশে চাহিদার ৮০ শতাংশ আতশবাজি সরবরাহ করে। এই দুই এলাকার ব্যবসায়ীরা ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে কমপক্ষে ৫০-৬০ কোটি টাকার আতশবাজি, ফানুস বিক্রি করেন। আতশবাজি আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বজায় রেখে সবুজ পটকা তৈরির অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই এলাকায় বিকেল থেকে লুকিয়ে ফানুস ও আতশবাজি বিক্রি করা হচ্ছে। একটি ফানুস ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়েছে।
চকবাজার এলাকার এক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফানুস ও আতশবাজি ভালোই বিক্রি হয়েছে। আমি কিছু আতশবাজি এনেছিলাম, যা বিকেলের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। ফানুস ৩০০টি এনেছিলাম তাও শেষ। নিষেধাজ্ঞা থাকে তাও ছেলেপেলে গোপনে এসে নিয়ে যায়।
চকবাজারে ফানুসের পাইকারি ব্যবসায়ী আল আমিন জানান, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গত বছরের মতো এবারও ফানুসের চাহিদা আছে। এক সপ্তাহ আগে থেকেই ফানুস কিনে নিয়ে গেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতারা।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের আগে থেকেই সতর্ক করে গেছে। তবুও অনেকে চড়া মূল্যে গোপনে পটকা, আতশ বিক্রি করছে। এবার কয়েক হাজার ফানুস বিক্রি করেছি গোপনে। তবে আমরা পটকা বিক্রি করছি না এবার।
কেরানীগঞ্জ থেকে শাঁখারিবাজারে আতশবাজি ও ফানুস কিনতে এসেছেন সুমিত দাস। তিনি বলেন, এ বছর ফানুস পাওয়া যাচ্ছে না। আগে যারা ফানুস বিক্রি করতেন তারা এ বছর না করে দিয়েছেন। তারপর আমাদের পরিচিত এক দাদাকে ফোন দিলে তিনি আমাদের কিছু ফানুস ও আতশবাজির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু দাম অনেক চড়া। থার্টি-ফার্স্ট নাইটে বন্ধুরা মিলে বাড়ির ছাদে পার্টি দেব। তাই কিছু ফানুস ও আতশবাজি কিনেছি। রাতভর গানবাজনা হবে। সরকার তো বাইরে পার্টি বা অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছে। তাই বন্ধুরা মিলে নিজ বাড়ির ছাদেই ছোট করে এই আনন্দ আয়োজন করা হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে আতশবাজি, পটকা, ফানুস ও মশাল মিছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, আতশবাজি, পটকা, ফানুস ও মশাল মিছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। ৩১ ডিসেম্বর ইংরেজি নববর্ষের প্রাক্কালে ডিএমপি এলাকার বাসিন্দারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে অংশ নেবে। তবে এ আনন্দ উৎসব উদযাপনের নামে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি নিজস্ব সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং- III/৭৬) এর ২৮ ও ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে ১৮ ডিসেম্বর সোমবার রাত ১২টা থেকে শুভ বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন উৎসবমুখর এবং নিরাপদ পরিবেশে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব প্রকার আতশবাজি, পটকা ফুটানো, ফানুস উড়ানো ও মশাল মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনে অনেকেই ফানুস উড়িয়ে আনন্দ করেন। এতে সারা দেশে অন্তত ২০০টি স্পটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে শুধু রাজধানীতেই ১০টি স্পটে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। শুধু রাজধানীর এই স্পটগুলোর আগুন নিয়ন্ত্রণে ওই রাতে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট কাজ করেছে। ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে জানা যায়, এসব আগুনের কারণ ফানুস ওড়ানো। এসব আগুনে হতাহতের ঘটনা না থাকলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তবে এ বছর ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি ফোটানোর বিষয়ে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এরপরও যদি এর ব্যত্যয় ঘটে এবং নগরবাসীর নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে, তবে নিরাপত্তার স্বার্থে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও বিক্রি হচ্ছে আতশবাজি ও ফানুস।
Leave a Reply