সরকার আলুর দাম বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে অভিযান শুরু করেছে। তবে অভিযানের পরও জয়পুরহাট জেলায় আলুর দাম কমেনি, বরং সরবরাহে টান দেওয়া হয়েছে। এই সুযোগে বাজারে আলুর দাম বেশি নিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারা। হিমাগার থেকে আলু সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি অফিসের তথ্য বলছে, জেলায় এবার ৩৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। আলু উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ ২৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে জেলার ১৯টি হিমাগারে ১ লাখ ৬৫ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন আলু রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আলু রাখা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ১০৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চারভাগের একভাগ বীজ আলু। বাকি আলু খাওয়ার জন্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হিমাগারে কৃষকেরা যেসব আলু রাখেন সেগুলো বেশির ভাগ বীজ আলু। তাদের কিছু আলু খাবার জন্য থাকে। কৃষকেরা বীজ আলু উত্তোলনের সময় যেটুকু বীজের জন্য লাগবে তা রেখে বাকি আলু বিক্রি করে দেন। তখন আলুর দাম কিছুটা কম থাকে। তবে হিমাগারে ব্যবসায়ীদের আলু বেশি থাকে। এগুলো সবই খাওয়ার আলু। তারা সিন্ডিকেট করে হিমাগার থেকে বেশি দামে আলু বিক্রি করেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে আলু বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আর.বি হিমাগারের তিন আলু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে ভোক্তা অধিদপ্তর সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ওই অভিযানের পর সকল হিমাগার থেকে আলু সরবরাহ কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তখন পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
জয়পুরহাট শহরের মাছুয়া বাজার নতুনহাট ও পূর্ব বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরায় সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম নয়, বরং তার চেয়ে বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। জাম আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা, স্টিক ৪০ টাকা, ভান্ডারপুর ৫৫ টাকা, ফাটা পাকরি ৫০ টাকা ও স্টিক কাটা আলু ৩০ টাকা।
আলু হিমাগারে রাখার সময় প্রকারভেদে দাম পড়েছিল ১০-১৫ টাকা কেজি। হিমাগার থেকে বের করার সময় সব খরচ বাদে ওই আলুর দাম পড়বে ১৭-২২ টাকা কেজি। সরকারের বেঁধে দেওয়া পাইকারি দাম ২৬-২৭ টাকা কেজি এবং খুচরায় ৩৫-৩৬ টাকা কেজি। এই দামে আলু বিক্রি করলে মজুতদার ও খুচরা পর্যায়ে লাভ থাকবে। কিন্তু সিন্ডিকেট করে ৪০-৬৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করা হচ্ছে।
জয়পুরহাট জেলা শহরের পূর্ব বাজারে কোনো সবজির দোকানে আলু পাওয়া যায়নি। সেখানকার সবজি ব্যবসায়ী বিরেন মহন্ত বলেন, প্রকারভেদে প্রতি কেজি আলু ৩৮ টাকা থেকে ৪৫ টাকা দরে পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে। তাহলে খুচরায় আমরা কত টাকায় বিক্রি করবো? এর মধ্যে পরিবহন খরচ, পলিথিন, শ্রমের দাম আছে। তারপরও আলু নাকি ৩৬ টাকা থেকে ৩৭ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হবে। আমরা এই দামে আলু কিনতেই পারছি না। তাহলে বেচবো কত টাকায়? এজন্য আলু বিক্রি বন্ধ করে দিছি। আমাদের এই বাজারের কোনো সবজি ব্যবসায়ীর দোকানে আলু নেই।
হিমাগার সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার দাম বেঁধে দেওয়ার পরও আলুর দাম বেশি ছিল। ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের পর হিমাগারে আলু রাখা ব্যবসায়ীরা আর আলু বের করছেন না। তাছাড়া হিমাগারে রাখা আলু ৬০ শতাংশের ওপর বেরিয়ে গেছে। বাকি যে আলু আছে এর মধ্যে ২৫ শতাংশ খাবার আলু ও ১৫ শতাংশ বীজ আলু।
মোল্লা কোল্ড স্টোরেজ লিামিটেডের ম্যানেজার আবু সালেক বলেন, গত দুই-তিন ধরে হিমাগার থেকে বের হওয়া কোনো আলু শেডে পড়েনি। ব্যবসায়ীরা আলু বিক্রির জন্য বের করছেন না। একই অবস্থা এম ইশরাত, নর্থওয়েস্ট, আরবি, পুনট কোল্ড স্টোরেজসহ কয়েকটি হিমাগারে। পুনট হিমাগারে আলু বের করা হলেও সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে না। এসব আলু অন্যত্র সরিয়ে আবারও মজুত করা হচ্ছে।
হিমাগারে আলু কেনার পর বিভিন্ন অঞ্চলের মোকামে দিয়ে থাকেন ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে শেডে আলু পড়ছে না। সরকার ২৭ টাকা কেজি দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই দামের চেয়ে এক টাকা বেশিতে আলু কেনা যায়। কিন্তু ৩২ টাকা বা ৩৬-৩৭ টাকা দরে হিমাগারে আলু কেনা যাবে না। তাই আপাতত আলু কেনাবেচা বন্ধ রেখেছি। তাছাড়া কৃষকেরা যখন আলু বের করবেন তখন একটু দাম কমতে পারে। এর কারণ কৃষকরা তাদের আলু বিক্রি করে জমির সার, ওষুধসহ যাবতীয় জিনিস কিনবেন। কিন্তু এখন যেসব আলু বিক্রি হচ্ছে সেগুলো ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের।
জয়পুরহাট কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রতন কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে দেখা যাচ্ছে, মজুতদাররা হিমাগার থেকে আলু বেরও করছেন না, আবার বিক্রিও করছেন না। এতে খুচরা বাজারে দাম কমানো যাচ্ছে না। মজুতদাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন। তারা যদি কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন তাহলে কৃষি বিপণন আইন অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
Leave a Reply