গত ৫ আগস্ট তিনটার দিকেও রাজশাহীতে অবস্থান করছিলেন সিটি মেয়র এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। নগরীর আলুপট্টিতে আওয়ামী লীগ ও দলটির বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের রুখে দিতে রাস্তায় অবস্থান করছিলেন তিনি। তৎক্ষণে দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী লিটন আন্দোলন দমাতে ছিলেন তৎপর। ওইদিনই রাজশাহীতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একমাত্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে দুজন নিহতও হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা যায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। শেষ পর্যন্ত বিকেল সোয়া তিনটার দিকে নগরীর আলুপট্টির মোড় থেকে সরে যান মেয়র লিটন। এর পর আর তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি রাজশাহীতে। বিকেলের মধ্যেই স্বপরিবারে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহীতে শুরু হয় ব্যাপক হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নগর ভবনের দোতালা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত। পরে ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় বলে রক্ষা পায় বাকি ৫ তলা। যে নগর ভবন ও মেয়রের বাড়ি ছিল একসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পদচারণায় ব্যস্ত, এখন সেগুলোতে ভাঙ্গা-চোরা কাঁচের জানালা-দরজা ও ছায়-ভষ্মের স্তপ পড়ে আছে। হামলা ও অগ্নিসংযোগে মেয়রের বাড়িটি পরিণত হয়েছে যেন জরাজীর্ণ এক ভুতড়ে বাড়িতে। অথচ এই মেয়র লিটনই ছিলেন টানা প্রায় ১৬ বছর ধরে রাজশাহী নগরীর অন্যতম প্রতাপশালী ব্যক্তি। পলাতকের আগ পর্যন্ত রাজশাহী নগরীর অধিকাংশরই নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের জুনে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ কামারুজ্জামানের ছেলে ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। মাঝে একবার মেয়র নির্বাচিত না হতে পারলেও গোটা শহরের নিয়ন্ত্রক ছিলেন লিটনই। ফলে ওই সময় বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মেয়র থাকলেও তিনি ছিলেন কেবলমাত্র পুতুল মেয়রের মতো। আওয়ামী লীগ সরকারের অসহযোগিতায় তৎকালীন মেয়র বুলবুল ছিলেন কোণঠাসা।
এর পর দ্বিতীয়বার ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে উন্নয়নের মাধ্যমে রাজশাহী নগরীর দৃশ্যপট পাল্টে দেন তিনি। গ্রীণসিটি ক্লিনসিটি হিসেবে রাজশাহীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। পাশাপাশি লিটনের প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেড়ে যায়। ধিরে ধিরে অনেকটায় প্রতাপশালীতে পরিণত হোন লিটন। এতে করে রাজশাহী নগরীর সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাঁর হাতে।
কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে গত বছর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিতে থাকে মেয়র লিটনকে ঘিরে। দলের মধ্যেই লিটনকে ঘিরে গড়ে উঠে একটি পক্ষ। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারসহ চারজন তৎকালীণ ও দুজন সাবেক এমপি জোট বেধে লিটনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। দলীয় সভানেত্রী ও সাবেক তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও লিটনের দফায় দফায় নানা অভিযোগ করতে থাকেন তাঁরা। ফলে দলের মধ্যেই অনেকটায় কোণঠাসা হতে থাকে মেয়র।
শেষ পর্যন্ত কোটা আন্দোলন ঘিরে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে লিটন নেতাকর্মীদের একসঙ্গে নিয়ে মাঠে নামেন। ফলে শুরু থেকে একেবারে শেষদিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা একজোট হয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের রুখে দিতে নানাভাবে তৎপর ছিলেন। এতে করে শুরু থেকে একেবারে শেষদিন পর্যন্তও রাজশাহীতে আন্দোলনকারীরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। এমনকি আন্দোলনের একেবারে শেষ দিন দুপুরেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
দুই হাতে দুটি রিভলবার নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করতে দেখা যায় যুবলীগ নেতা রুবেল হোসেনকে। সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই একজন আন্দোলকারী নিহত হন। এর পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীণ অবস্থায় মারা যান আরও একজন। দুপুর একটার দিকে ওই সংঘর্ষের পরও নগরীর আলুপট্টিতে অবস্থান নিয়ে ছিলেন মেয়র লিটন। মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা ঠেকাতে তিনি আলুপট্টি মোড়ে বসেছিলেন দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বিকেল সোয়া তিনটার দিকে তিনি সেখান থেকে সরে গিয়ে স্বপরিবারে আত্মগোপনে চলে যান।এর পর নগর ভবনসহ তাঁর বাড়িতেও চালানো হয় হামলা। দুর্বৃত্তরা বাড়ির সব মালামাল লুট করতে থাকেন।
প্রত্যক্ষদর্শী একটি সূত্র জানিয়েছে, যাওয়ার সময় মেয়র লিটনসহ তার পরিবারের সদস্যরা এক কাপড়ে বের হয়ে গেছেন। তড়ি-ঘড়ি করে বের হওয়ার কারণে সঙ্গে তারা কিছুই নিয়ে যেতে পারেননি। বাড়িতে সবকিছু ফেলে রেখে গেছিলেন।এর পর সেগুলো লুটপাট ও ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। চালানো হয়।
গতকাল সরেজমিন মেয়র লিটনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, যে বাড়িটি একসময় সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারায় নিরাপত্তাবেষ্টনীর জাল বিছানো ছিল। এখন সেখানে একটি মানুষও নাই। প্রধান ফট থেকে শুরু করে গোটা বাড়ির একটি দরজাও অবশিষ্ট নাই। সবকটি খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর আগুন দিয়ে ও ভাংচুর করে নষ্ট করা হয়েছে কাঁচেরগুলো। বাড়ির ইটও খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গোটা বাড়িটিই এখন এক ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এতো মানুষের যাতায়াত ছিল যে বাড়িটিতে, এখন ঘুরে কেউ আর তাকায় না। যারা দেখতে আসে, তারা আসে শুধু ভাঙা-চুরা আর আগুনে পুড়ে যাওয়া দৃশ্য দেখতে। অথচ পালানোর দিন পর্যন্ত এই বাড়িতেই স্বপরিবারে অবস্থান করছিলেন মেয়র লিটন।’
হাসিবুর রহমান নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘মেয়রের বাড়ির ইটও খুলে নিয়ে গেছে মানুষ। আর ঘরের বিছানা থেকে শুরু করে, থালা-বাসন, বিভিন্ন আসবাবপত্র, জুতা-স্যান্ডেল, কাপড়, টাকা-পয়সা, সোনার গহনা থেকে শুরু করে এমন কোনো জিনিসপত্র ছিল না যেগুলো লুট হতে বাকি ছিল।অনেকেই ক্ষোভে ভাংচুর করেছে। আর কেউ কেউ এসেছিল লুটপাট করতে।’
রাসিক সূত্র মতে, মেয়র লিটন ছাড়াও ২৬ জন কাউন্সিলর আত্মগোপনে আছেন ওইদিন থেকেই। এতে করে ব্যহত হচ্ছে নাগরিক সেবাও। এমনকি কোনো কোনো রাস্তায় দিনের বেলাতেও জ¦লছে রঙ্গিন লাইন। যে লাইটগুলো নিয়ে নগরবাসীর যেমন আগ্রহের শেষ ছিল না, তেমনি সমালোচনাও কম হয়নি।
রাসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান মিশু জানান, মেয়রসহ অন্তত ২৬ জন কাউন্সিলর গত ৫ আগস্টের পর নগর ভবনে আসেননি। নগর ভবনে আসার পরিবেশও নাই বলে তিনি দাবি করেন। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে নাগরিক সেবা দিতে গিয়েও হিমশিক খেতে হচ্ছে তাদের।
Leave a Reply