হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মস্থান। হিজাজের রাজধানী। মুসলমানদের পবিত্রতম তীর্থস্থান কাবা শরিফ এখানে অবস্থিত। লোহিত সাগরের তীরবর্তী বন্দর জেদ্দা থেকে আনুমানিক ৫০ মাইল পূর্বে এবং রিয়াদ থেকে ৪৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পাহাড়বেষ্টিত সংকীর্ণ ও অনুর্বর উপত্যকাভূমিতে অবস্থিত মক্কা নগরের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই মাইল। চারদিকে কোনো দেয়াল নেই। উত্তর-দক্ষিণগামী প্রাচীন বাণিজ্যপথটি (মসলা সড়ক) মক্কার ভেতর দিয়ে চলে গেছে। এই পথে পূর্ব দেশগুলো থেকে মসলা, সুগন্ধি দ্রব্য ও অন্যান্য পণ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আসত।
পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘কৃষির অনুপযোগী’ এই উপত্যকা অনুর্বর। এখানে অসহ্য গরম পড়ে। নগরের চারপাশের পাহাড়ে নানা ধরনের প্রাসাদ অবস্থিত।
নগরের মধ্যস্থলে উপত্যকার তুলনামূলকভাবে নিচু জায়গায় বিরাট ‘মসজিদুল হারাম’ (পবিত্র মসজিদ)। এখানে এসে শেষ হয়েছে চারদিক থেকে আসা প্রশস্ত পাকা বিভিন্ন রাস্তা। ইরাকি স্তম্ভ (রুকন), সিরীয় স্তম্ভ, ইয়ামিনি স্তম্ভ ও কৃষ্ণস্তম্ভ নামে চারটি স্তম্ভ দিয়ে পরিবেষ্টিত মসজিদটির বিরাট চত্বরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চার কোনাবিশিষ্ট পবিত্রতম কাবা গৃহ।
হজরত আদমের (আ.) সময় থেকে পবিত্র কাবাকে ভিত্তি করে মক্কার ইতিহাসের শুরু। হজরত আদম (আ.) বেহেশতের পবিত্র ঘর বায়তুল মামুরের অনুকরণে প্রথম এটা নির্মাণ করেন। হজরত নুহের (আ.) আমলের মহাপ্লাবনের পর (বিশ্বাস করা হয় যে, এই সময় কাবা ঘরকে বেহেশতে তুলে নেওয়া হয়) হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) এটা পুনর্নির্মাণ করেন।
কাবার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রাখা আছে ‘হাজরে আসওয়াদ’ (কৃষ্ণপ্রস্তর)। চত্বরের মধ্যেই রয়েছে হজরত হাজেরা (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর সৃষ্ট জমজম কূপ। ‘মাসআয় সুওয়াইকা’ নামে পরিচিত মক্কার প্রধান বাজার পবিত্র সাফা (দক্ষিণ-পূর্ব) ও মারওয়া (উত্তর-পূর্ব) পাহাড়কে সংযুক্তকারী প্রশস্ত রাস্তার দুই পাশে অবস্থিত। এটা রেশমি বস্ত্র, তসবির মালা এবং আতর প্রভৃতি সুগন্ধি দ্রব্যের জন্য বিখ্যাত। ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত উপাদান তৈরি করা ছাড়া মক্কার নিজস্ব কোনো শিল্প নেই। হজ ও ওমরাহর সময় হাজিদের ভরণপোষণ ও তত্ত্বাবধানই এর একমাত্র আয়ের সূত্র।
বর্তমানে প্রতিবছর ২০ লক্ষাধিক মুসলমান পবিত্র হজ পালন করে থাকেন। তীর্থ ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মক্কা নগর অতি প্রাচীনকাল থেকে প্রসিদ্ধ। টলেমি মক্কাকে ম্যাকোরাবা বলে উল্লেখ করেছেন। এটা সাবিয়ান মাকুরাবা (পবিত্র স্থান) শব্দ থেকে এসেছে। হজরত আদমের (আ.) সময় থেকে পবিত্র কাবাকে ভিত্তি করে মক্কার ইতিহাসের শুরু। হজরত আদম (আ.) বেহেশতের পবিত্র ঘর বায়তুল মামুরের অনুকরণে প্রথম এটা নির্মাণ করেন। হজরত নুহের (আ.) আমলের মহাপ্লাবনের পর (বিশ্বাস করা হয় যে, এই সময় কাবা ঘরকে বেহেশতে তুলে নেওয়া হয়) হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.) এটা পুনর্নির্মাণ করেন। তাঁদের কাছেই হজরত জিবরাইল (আ.) পবিত্র ‘হাজরে আসওয়াদ’ প্রদান করেন। এটি পুরুষাণুক্রমে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধরদের তত্ত্বাবধানে ছিল। তাঁদের কাছ থেকে হস্তান্তরিত হয়ে প্রায় দুই হাজার বছর পর্যন্ত পবিত্র কাবাসহ মক্কা নগর বনু খুজাআহ গোত্রের তত্ত্বাবধানে ছিল। তাদের আমলেই একেশ্বরবাদের জায়গায় কাবা গৃহে ‘হুবাল’ মূর্তি স্থাপনের মাধ্যমে প্রথম মূর্তিপূজার প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন গোত্র ৩৬০টি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে মক্কা পুনরায় হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর কুরাইশদের তত্ত্বাবধানে আসে। ইতিমধ্যে মক্কা নগর এশিয়া ও আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। উত্তর-দক্ষিণগামী বাণিজ্যপথে মারিব ও গাজা শহর দুটির মধ্যবর্তী স্থানে মক্কা অবস্থিত।
মহানবী (সা.)-এর আমলে আবু সুফিয়ান মক্কার বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে গাজা থেকে প্রত্যাবর্তনের পথেই বদরের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময় তাঁর কাফেলায় ১ হাজার উট ও ৫০ হাজার দিনার (২০ হাজার পাউন্ড) মূল্যের পণ্য ছিল। প্রাক্-ইসলামি যুগে বাণিজ্যকেন্দ্র ছাড়া তীর্থকেন্দ্র হিসেবেও মক্কার বিশেষ উন্নতি সাধিত হয়। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) এখানকার কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের বছরই ইয়েমেনের শাসনকর্তা আবিসিনীয় সেনাপতি আবরাহা হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ করেন। আল্লাহর গজবে হানাদাররা বিধ্বস্ত হয়। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে হিজরি সনের সূচনা করেন। অষ্টম হিজরিতে (৬৩০) তিনি মক্কা জয় করেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি মক্কায় অতিবাহিত করেন বলে এখানে তাঁর কাছে যেসব ‘ওহি’ নাজিল হয়, সেগুলো ‘মক্কি’ নামে পরিচিত।
হিজরতের পর ধীরে ধীরে মক্কার উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত মদিনা শহরই ইসলামের প্রধান কেন্দ্র হয়ে পড়ে। ৬৯২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা উমাইয়াদের কর্তৃত্বাধীনে আসে। এই সময় থেকে বাণিজ্যিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। বিলাসিতাপূর্ণ জীবন মক্কার ঐতিহ্যগত পবিত্রতাকেও অনেকখানি ক্ষুণ্ন করে। ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে গোঁড়াপন্থী কারামতিয়া সম্প্রদায় মক্কা নগর ধ্বংস করে ‘হাজরে আসওয়াদ’ অপহরণ করে। ৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে এটা পুনরুদ্ধার করা হয়।
মিসরীয়দের আমলে এবং ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দের পর তুর্কিদের আমলে মক্কা নগর স্থানীয় হাশিমি বংশের আমিরদের (পরবর্তীকালে শরিফ) দিয়ে শাসিত হতো। ১৮০৩-১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা ছিল ওয়াহাবিদের অধিকারে। নগরটি আবার তুর্কিদের কর্তৃত্বাধীন আসে। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে হাশিমি বংশের আমির হুসেন ইবনে আলী তুর্কিদের বিতাড়িত করে মক্কাসহ সমগ্র হিজাজের স্বাধীন বাদশাহ হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে সউদ মক্কা জয় করেন এবং বর্তমানে এটা সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত।
প্রাক্-ইসলামিক যুগে চিকিৎসা, সংগীতবিদ্যা ও শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্র ছিল মক্কা। এর নিকটবর্তী ‘উকাজ’ নামক স্থানে বার্ষিক মেলা ও সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো।
সম্মেলনে নির্বাচিত মআল্লাহ নামে বিখ্যাত শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো কাবা শরিফের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। উমাইয়াদের আমলেও এটা একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
নগরের উত্তর-পশ্চিম দিকে মিনা ও মুজদালিফা এবং পূর্ব দিকে আরাফাত ময়দান। হজের সময় এসব স্থানে বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে হয়।
সূত্র: ‘মক্কা’, যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪
Leave a Reply