# সেতুর কাছে থাকবে রেকার ও জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা
# গাড়িতে ড্যাশক্যাম ও চালকদের লাইভ লোকেশন শেয়ারের অনুরোধ
ঈদ উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করেন প্রায় দেড় কোটি মানুষ। এদের মধ্যে অধিকাংশই সড়কপথ ব্যবহার করেন। ফলে সড়কপথ যদি চলাচলের জন্য সচল না রাখা যায়, তবে ঈদযাত্রা ভোগান্তিতে পরিণত হবে ঘরমুখো মানুষের জন্য।
আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশু পরিবহনের কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে। একই সময়ে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াতে যাত্রীবাহী গাড়ির চাপও থাকবে। এর ফলে সড়ক ব্যস্ত হয়ে উঠবে। এর মধ্যে মহাসড়কের ওপর বা পাশে বসা অস্থায়ী পশুর হাটগুলো যান চলাচলকে আরও ধীরগতির করে তুলতে পারে, যা বাড়াতে পারে যানজট ও মানুষের ভোগান্তি।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল আজহার সময় দেশের মহাসড়কের ওপর বা পাশে প্রায় ২১৭টি স্থানে কোরবানির পশুর হাট বসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হাট বসে চট্টগ্রাম জেলায়। এসব হাটের কারণে সড়কে যানবাহনের গতি কমে যায় এবং সৃষ্টি হয় যানজট, ফলে ভোগান্তিতে পড়েন ঘরমুখো মানুষ। এ পরিস্থিতি এড়াতে এবারের কোরবানির ঈদে মহাসড়কের ওপর বা পাশে হাট ইজারা না দিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
এছাড়া সড়ক ও মহাসড়কের ১৫৯টি স্থানকে সম্ভাব্য যানজটপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্পট রয়েছে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে। এসব স্থানে মনিটরিং টিম গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা না হলে যানবাহনের চাপ বেড়ে বড় ধরনের যানজট ও ভোগান্তি হতে পারে।
তবে, সড়ক সংশ্লিষ্টরা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, এবার কোনোভাবে সড়ক-মহাসড়কের ওপর কোরবানির পশুর হাট বসতে দেওয়া হবে না।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ ভবনে সড়ক, সেতু ও রেলপথে যাত্রীদের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে আয়োজিত অংশীজন সভা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
অস্থায়ী পশুর হাট বসে যেসব সড়ক-মহাসড়কে
দেশের বিভিন্ন জেলায় মহাসড়কের ওপর বা পাশে প্রায় ২১৭টি কোরবানির পশুর হাট বসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি—৩০টি হাট বসে চট্টগ্রাম জেলার সড়ক সংলগ্ন এলাকায়। এরপর কক্সবাজারে ২৩টি, ঢাকায় ১৫টি এবং কুমিল্লা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলাজুড়ে মোট ১৪টি হাট বসে। নাটোর-রাজশাহী মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকায় বসে ১২টি হাট, গাজীপুর জেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকায় ১১টি, নারায়ণগঞ্জে ১৩টি এবং বগুড়া ও পঞ্চগড় জেলায় ৯টি করে হাট বসে। এছাড়া দেশের আরো বিভিন্ন জেলার মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কের পাশে ২ থেকে ৫টি করে পশুর হাট বসে, যা ঈদের সময় যানজট ও ভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সভায় অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হাটের প্রবেশমুখ সড়কের বিপরীত দিকে নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, যাতে মহাসড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে। পশুবাহী যানবাহনের জন্য মহাসড়কের বাম পাশ দিয়ে চলাচল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ফিরতি পথে পশুবাহী ট্রাকে কোনোভাবেই যেন যাত্রী পরিবহন না হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ এবং পরিবহন শ্রমিক সংগঠনকে। একইসঙ্গে মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সড়কের ওপর ধান, খড়, কাঠ ইত্যাদি শুকানো বা নির্মাণ সামগ্রী রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মহাসড়কে সম্ভাব্য যানজট স্পটে নজরদারির সিদ্ধান্ত
যানজটের সম্ভাব্য ১৫৯টি স্পটের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ৪৯টি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের ৫৪টি, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ৬টি, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৪২টি, ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কের ৮টি এবং ঢাকা-ভাঙা-বেনাপোল, ঢাকা-বরিশাল ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্পটে ঈদের আগে ও পরে যানজটের আশঙ্কা বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে এসব এলাকায় যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিতে বলা হয়েছে। স্পটগুলোতে কার্যকর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশ, জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং টিম গঠন করে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই টিমগুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার যানজট সমস্যা সমাধানে কাজ করবে এবং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। পাশাপাশি, এসব স্পটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে, যাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক থাকে।
সভায় বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, এবারের কোরবানির ঈদে মহাসড়কের ওপর বা তার আশপাশে কোনো পশুর হাট বসানো হবে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজ করছে, যাতে সড়কের মধ্যে পশুর হাটের কোনো কার্যক্রম না থাকে। হাটগুলোকে সড়ক থেকে যতটা সম্ভব দূরে স্থানান্তরিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে যান চলাচলে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি না হয়।
ঈদের ৭ দিন আগেই মহাসড়ক সংস্কারের নির্দেশ
জাতীয় মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ করিডরগুলোর মধ্যে ঢাকা বাইপাস (মদনপুর-ভুলতা-ভোগড়া-এন১০৫), নবীনগর-চন্দ্রা-এন৫৪০, ঢাকা-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-এন৩, ঢাকা-জয়দেবপুর-এন৩, ঢাকা (ভোগড়া)-চন্দ্রা-এলেঙ্গা, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-বগুড়া-রংপুর, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-গোপালগঞ্জ-খুলনা, ভাঙা-বরিশালসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ করিডর এবং কালামপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মির্জাপুর, টাঙ্গাইলমুখী সড়কগুলোর মেরামত ও সংস্কার কাজ ঈদের ৭ দিন আগেই শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ সব মহাসড়কে ঈদের সময় ৭ দিনের জন্য উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে যানজটের সৃষ্টি না হয় এবং ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন থাকে।
টোল প্লাজায় সার্বক্ষণিক ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) বুথ চালুর নির্দেশ
সওজের আওতাধীন ৯টি সেতু এবং মহাসড়কে, যথাক্রমে কর্ণফুলি সেতু, মেঘনা সেতু, গোমতী সেতু, পায়রা সেতু, খান জাহান আলি (রূপসা) সেতু, চরসিন্দুর সেতু, শহীদ ময়েজউদ্দিন সেতু, আত্রাই টোল প্লাজা, নাটোর, লালন শাহ সেতু এবং ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ইটিসি বুথ চালুর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক টোল আদায় অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সেতু বিভাগের আওতাধীন পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু ও কর্ণফুলি টানেলেও ইটিসি বুথ সার্বক্ষণিক চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে যানজট কমে এবং টোল আদায় প্রক্রিয়া সুগম হয়।
এছাড়া ঈদের ছুটির আগে ও পরে সেতু পারাপারের জন্য আগাম টোল টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে, যাতে যাত্রীরা আগেভাগে টোল পরিশোধ করতে পারেন এবং স্বস্তির সঙ্গে যাত্রা করতে পারেন। অন্যদিকে টোলের সমপরিমাণ টাকা ভাংতি রাখতে বলা হয়েছে চালকদের জন্য। এবং টোল প্লাজাগুলোতে পশুবাহী গাড়ির জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে, যাতে যানজট কমানো যায় এবং কোরবানির পশু পরিবহন নির্বিঘ্ন করা যায়।
এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, ঈদের সময় সেতুগুলোর কাছে রেকার রাখা থাকবে। কোনো গাড়ি সেতুর ওপর নষ্ট হয়ে গেলে যেন সেটিকে দ্রুত সরানো যায়। আমরা জ্বালানি তেলের ব্যবস্থাও রাখবো। প্রতিটি টোল প্লাজায় ২টি করে ইটিসি চালু রাখা হবে। কোনো অবস্থায় যেন সেতু এলাকায় গাড়ি চলাচল বন্ধ না হয়, সে বিষয়ে আমাদের কর্মীদের সজাগ দৃষ্টি থাকবে।
সড়কের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, রোজার ঈদে একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, এবার হয়েছে দুটি। একে-তো ঘরমুখো মানুষ যাবে, অন্যদিকে কোরবানির পশু আসবে। সার্বিক নিরাপত্তা দিতে আমাদের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গতবার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ঢাকা ও এর আশেপাশের মহাসড়ককে। এবার প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই এবার মহাসড়কের ওপর পশুর হাট বসতে দেওয়া হবে না।
মহাসড়কে ডাকাতির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন মহাসড়কে ডাকাতি অনেক কমে গেছে। আমরা আমাদের ওসিদের নির্দেশ দিয়েছি, যার যার এলাকায় পশুর হাটে যতগুলো ফড়িয়া আছে, তাদের তালিকা করতে। তাদের সঙ্গে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকবে। পশুবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বাসে ডাশক্যাম লাগানোর কথা বলেছি। যাতে কেউ ডাকাতি করলে তাতে সহজে আইডেন্টিফাই করা যায়। পরিবহন মালিকদের সঙ্গে সামনে বৈঠক আছে। আমরা চালকদের লাইভ লোকেশন শেয়ার করতে বলবো।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, আমরা একটি ওয়েবসাইট চালু করতে যাচ্ছি। ওয়েবসাইটে লোকেশন অনুযায়ী হাইওয়ে থানা, থানা সংশ্লিষ্টদের মোবাইল নম্বর, ওয়ার্কশপ, রেস্টুরেন্ট সবকিছুর সুবিধা পাওয়া যাবে।
চাঁদাবাজির বিষয়ে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক ও পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিক পরিষদের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, গত ঈদে কোনো চাঁদাবাজি হয়নি, এবারো হবে না আশা করছি। চাঁদাবাজির বিষয়ে কোনো অভিযোগ আমাকে গভীর রাতে জানালেও সেটি উপদেষ্টাকে জানিয়েছি ব্যবস্থা নিতে। এবারো তার বিকল্প হবে না।
Leave a Reply