একটি আয়োজনে অংশ নিতে ঢাকা থেকে রাজশাহী এসেছিলেন ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্টের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান। তিনি রাজশাহী শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখে অভিভূত হন। তবে আক্ষেপ নিয়ে বলেন, এতা সুন্দর একটা সাজানো-গোছানো শহরটাকে নষ্ট করেছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। মূল শহরে পায়ে হেঁটে চলাও দায় অটোরিকশার কারণে। ছোট এই শহরে এতো অটোরিকশার কোনো দরকার নাই। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এই শহরটির এখন অন্যতম সমস্যা মনে হচ্ছে অটোরিকশা। উন্নয়নে পাল্টে গেছে নগরী। কিন্তু অটোরিকশার চাপে যেন ধূঁকছে।’
এমন অভিমত, শুধু জাহিদুর রহমানের কণ্ঠেই নয়, রাজশাহী নগরবাসীও যেন এই অটোরিকশায় ধূঁকছেন। আবার অদক্ষ চালক এবং নিয়ন্ত্রণহীন চলাচলের কারণে প্রতিদিনই শহরে ঘটছে ছোট-বড় র্দুটটনা। ঘটছে প্রাণহানীর ঘটনাও। কিন্তু তার পরেও এই অটোরিকশার লাগাম টানার যেন বিকল্প কোনো উপায় পাচ্ছে না রাজশাহী নগর সংস্থা এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ। আর সেই সুযোগে বেড়েই চলেছে অটোরিকশা। বর্তমানে যা গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৭০ হাজারের ঘরে। অথচ রাজশাহী নগর সংস্থা মাত্র ৯ হাজার অটোরিকশার নিবন্ধন দিয়েছে এখন পর্যন্ত। আর সেই নিবন্ধন নম্বরগুলো নিয়েই শহরজুড়ে চলাচল করছে অন্তত ৭০ হাজার অটোরিকশা। ফলে একই নিবন্ধন নম্বরে চলছে চার-পাঁচটি করে অটোরিকশা। একেকটা রুটে চলছে এসব নম্বরের অটোরিকশা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ভোরের আলো পূর্বদিগন্তে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী নগরীর প্রধান-প্রধান সড়কগুলো থেকে শুরু করে অলি-গলির রাস্তাগুলোও চয়ে যাচ্ছে অটোরিকশার দখলে। পরিস্থিতি এমন-যেন যাত্রীর চেয়ে অটোরিকশার সংখ্যা বেশি। নগরীর সাহেব বাজার, লক্ষীপুর, রেলগেট, বন্ধগেট, কাদিরগঞ্জ মোড়, বর্ণালীর মোড়, লোকনাথ স্কুল মার্কেট মোড়, রাজশাহী কলেজ গেট, সোনাদিঘীর মোড়, আলুপট্টির মোড়, কাজলা মোড়, বিনোদপুর বাজার, সালাবাগান বাজার, নওদাপাড়া বাজার ও কোর্ট বাজারগুলোতে যেন অটোরিকশার জট লেগেই থাকে। বিপুল পরিমাণ এই অটোরিকশার জট থামাতে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশরাও। অদক্ষ চালক আর নিয়ন্ত্রণহীন অটোরিকশার কারণে হরহামেশায় ঘটছে দুর্ঘটনা। এমনকি প্রাণ হারাতেও হচ্ছে।
রাসিক সূত্রে জানা গেছে, মাসের প্রথম সপ্তাহে সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মেরুন রঙ এবং দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পিত্তি রঙের অটোরিকশা চলাচলের জন্য নিয়ম বেধে দেয় রাসিকপরের সপ্তাহে সকাল ৬টা থেকে দুইটা পর্যন্ত পিত্তি রঙ এবং আড়াইটা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত মেরুন রঙের অটোরিকশা চলাচল করা কথা। । কিন্তু এই নিয়মও এখন মানছেন না চালকরা। যার যখন খুশি তখনই শহরের রাস্তায় নেমে পগছেন অটোরিকশা নিয়ে। এতে প্রতিদিনই শহরের কোথাও না কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা। বাড়ছে প্রাণহানীর ঘটনাও।
রাসিক সূত্র মতে, ব্যাটারি চালিত দুই শ্রেণির অটোরিকশা চলে রাজশাহীতে। এর মধ্যে ৮ জন যাত্রীবাহন ক্ষমতাও অটোরিকশা রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার এবং দুইজন যাত্রীবাহী ছোট অটোরিকশা রয়েছে আরো প্রায় ৪৫ হাজার। সবমিলিয়ে অন্তত ৭০ হাজার অটোরিকশা চলাচল করছে ছোট্ট এই নগরীতে। তবে এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৪ হাজার ২৬২টি অটোরিকশার নিবন্ধন দেয়া হয় ২০১১-১৩ সালের মধ্যে। এর পর আগের সব নিবন্ধন বাতিল করে ২০২১ সালে নতুন করে অনলাইনে আবেদন জমা নিয়ে ৮ হাজার ৯০০টির মতো অটোরিকশার নিবন্ধন দেয় রাসিক। সবমিলিয়ে ১০ হাজার নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আবেদন জমা নেয় রাসিক। কিন্তু শহরে এখন চলছে অন্তত ৭০ হাজার অটোরিকশা।
সূত্র মতে, অটোরিকশা চালকদের অসহযোগিতার কারণেই দুই শিফটে দুই রংয়ের অটোরিকশা চলাচলের সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি রাসিক। অথচ নগরীতে এখনো প্রতিদিন প্রধান প্রধান সড়ক দখলে থাকছে অটোরিকশার। পূর্বের সব নিবন্ধন বাতিল করা হলেও সেই অটোরিকশাগুলোই আগের ভুয়া নিবন্ধন নিয়ে চলছে নগরীর রাস্তাগুলোতে।
গতকাল রাজশাহী নগরীর ব্যস্ততম এলাকার সাহেব বাজারে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, আশে-পাশের চারিদিকে অটোরিকশা আর অটোরিকশা। যেন ধাপ ফেলানোরও জায়গা নেই কোথাও। অটোরিকশার ভিড়ে মানুষগুলোকেও চোখে দেখা যায় না। সাহেব বাজারের অটোরিকশার যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয়েছে কমিউনিটি ট্রাফিক সদস্যদেরও। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এতো অটোরিকশার ভিড়ে কেউ কাউকে সামাল দিতে পারছেন না। এভাবে গোটা শহরে যেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে অটোরিকশার দাপটে। বলা যায় অটোর ফাঁদে পড়ে নাভিশ্বাস উঠে নাকাল হয়ে পড়েছেন নগরবাসী।
নগরীর সাহেববাজার এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী মাজতার হোসেন বলেন, সকাল ৮টার পর থেকেই শুরু হয় অটোরিকশার জট। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সাধারণ পথচারীসহ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদেরকেউ ভোগান্তিতে। আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ক্রেতারা আসতে বেগ পাচ্ছেন অটোরিকশার ভিড়ে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের মূখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, অটোরিকশা চালকরা অনেকটাই বেপরোয়া। এদের নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটে প্রচুর। আবার যানজট তো লেগেই থাকছে এই অটোরিকশার কারণে। আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করছি এ সমস্যা সমাধানের। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি দেখছি না অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে।’
জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সালেহ নূরে সাইদ বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা যানবাহন হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ। সিটি করপোরেশেনের পক্ষ থেকে এগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরবর্তিতে সেই সিদ্ধান্ত এখন একটু সিথিল করা হয়েছে। তবে দ্রুতই দুই শিফটে দুই রংয়ের অটোরিকশা চলাচলে আমরা কঠোর অবস্থানে যাবো।’
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নগরীতে দুই শিফটে কলাপাতা ও পিত্তি রংয়ের অটোরিকশা চালু করা। ওইদিন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ঘটা করে দুই শিফটের অটোরিকশা উদ্বোধনও করেন। কিন্তু সে নিয়মও মানছে না চালকরা। আবার একই নিবন্ধনে অনেক অটোরিকশা চলছে। এসব নিয়ে আমরা নগর পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি সমাধান করবো।’
Leave a Reply