টানা চারটি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বয়সসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) বিরুদ্ধে। গত ৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে তড়িঘড়ি করে এসব বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ পাওয়া ২২ জনের চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয়। ফলে বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের অন্য কর্মীদের মধ্যে বিরোধ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
নিয়োগগুলো হয়েছিল ডিএমটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিকের আমলে।
বিষয়টি নিয়ে ডিএমটিসিএল বলছে, সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সুপারিশ জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে আইনজ্ঞরা বলছেন, সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান যদি আইন অনুসরণ না করে নিয়োগ দেয়, তবে সেটি অবৈধ।
এদিকে, গত ১৪ আগস্ট ডিএমটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিষ্ঠানটির এমআরটি লাইন-৬ এ প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীরা চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য একটি চিঠি দেয়। পরে ২০ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে একই বিষয়ে স্মারকলিপি দেয় ডিএমটিসিএলের অধীন এমআরটি লাইনসমূহে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত জনবল নামের একটি পক্ষ।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, এমআরটি লাইন-৬ এর প্রকল্পে নিয়োজিত ৪৭ জন কর্মচারীর চাকরি স্থায়ীকরণে সুপারিশ করেছে অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে নবম গ্রেডের রয়েছেন ২২ জন। এমআরটি লাইন-৬ এর সংশোধিত জনবল কাঠামোতে ১৪১টি পদের অনুমোদন ছিল। এর মধ্যে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলীসহ মোট ৫৮টি পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করার জন্য নির্ধারণ করা হয়।
ডিএমটিসিএলের অধীন লাইনগুলো পরিচালনার জন্য বিশেষ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও সাধারণ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি— এ দুই ধরনের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে, সাধারণ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ডিএমটিসিএলের সরকারি বিধি অনুসরণ করা হয়নি। সরাসরি নিয়োগের ৩, ৪, ৫ ও ৬ নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে নবম গ্রেডে ৩৫ বছরের বয়সসীমা দেওয়া হয়।
অবৈধ নিয়োগে স্থায়ী হয়েছেন যারা
ওই চারটি বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ পাওয়া ২২ জনের তালিকা রয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ১৫ জনের যোগদানের সময় ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই। আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ধরা হয়েছে ২০২১ সালের ২২ জুলাই থেকে ২০২৬ সালে ২১ জুলাই পর্যন্ত। দুজনের যোগদানের সময় ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় ধরা হয়েছে।
অবশিষ্ট পাঁচজনের মধ্যে প্রথমজনের যোগদানের সময় ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, দ্বিতীয়জনের যোগদানের সময় ২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, তৃতীয়জনের যোগদানের সময় ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত, চতুর্থজনের যোগদানের সময় ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ২০২৪ সালের ২৭ জানুয়ারি থেকে ২০২৯ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং সর্বশেষ পঞ্চমজনের যোগদানের সময় ২০২২ সালের ১০ মার্চ আর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সময় ২০২৪ সালের ১০ মার্চ থেকে ২০২৯ সালের ৯ মার্চ পর্যন্ত সময় ধরা হয়েছে।
ওই ২২ জনের মধ্যে ২০ জন সহকারী ব্যবস্থাপক, একজন প্রোগ্রামার ও একজন প্রশিক্ষণ সমন্বয়ক রয়েছেন।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী নবম গ্রেডে নিয়োগের জন্য বয়সসীমা ৩০ বছর, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে তা ৩২ বছর। কিন্তু ডিএমটিসিএল তাদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়সসীমা ৩৫ বছর নির্ধারণ করে। ফলে সরকারি বিধি মেনে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে চাকরি স্থায়ীকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে
প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, কোম্পানির সার্ভিস রুলে যদি ৩৫ বছর বয়সসীমার কথা উল্লেখ থাকে, তা হলে কেবল এ ধরনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নিয়ম। তবে, বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার সময় কোনো অনুমোদিত সার্ভিস রুল ছিল না। বিজ্ঞপ্তি যদি অবৈধ হয়, তবে ওই বিজ্ঞপ্তির অধীনে নিয়োগও অবৈধ হয়ে যাবে। অবৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ করা জনবলের চাকরি চূড়ান্তকরণ বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
অভিযোগ উঠেছে, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্থ বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং সর্বোপরি ডিএমটিসিএল বোর্ডের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে ৩৫ বছর বয়সসীমা দিয়ে সার্কুলারের অধীনে লোকবল নিয়োগ দিয়েছেন।
এদিকে উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে জানানো হয়েছে, বিধিবহির্ভূত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত জনবলের চাকরি চূড়ান্তকরণ, শ্রান্তি বিনোদন, ভবিষ্যৎ তহবিল অনুমোদন, যোগদানকালীন দুটি বেতন বৃদ্ধি; সর্বোপরি জ্যেষ্ঠতা প্রদানসহ কোম্পানির সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অতি সম্প্রতি তড়িঘড়ি করে এসব প্রার্থীর চাকরি চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে ডিএমটিসিএলের চাকরি বিধিমালায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
অথচ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ৩, ৪, ৫ ও ৬ এর বাইরেও ২০১৩ সালে ডিএমটিসিএল কোম্পানি গঠনের পর এর আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এবং সব ধরনের সরকারি নিয়ম মেনে জনবল নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু তারা এখনও স্থায়ী হতে পারেননি।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের সুপারিশ অনুযায়ী, এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ডিএমটিসিএল কোম্পানি থেকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ৪৭ জন জনবল বিভিন্ন পদে যোগদান করেন।
অন্যদিকে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে লেখা অপর এক চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সুপারিশ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রশাসনিক অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমটিসিএলে যোগদান করা এমআরটি লাইন-৬ এ প্রেষণে নিয়োজিত একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, ১৫ জন সহকারী প্রকৌশলী, ১৮ জন উপ-সহকারী প্রকৌশলী, ১২ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং একজন হিসাবরক্ষকসহ মোট ৪৭ জন জনবলকে চাকরিতে যোগদানের তারিখ হতে স্থায়ী করা প্রয়োজন। ওই চিঠিতে বিভিন্ন সময় তাদের চাকরিতে স্থায়ী করার আলোচনা ও সিদ্ধান্তগুলো যুক্ত করা হয়েছে।
সার্ভিস রুলস না থাকা প্রতিষ্ঠানে সরকারি বিধি অনুযায়ী নিয়োগ
সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সার্ভিস রুলস না থাকলে এবং সেই প্রতিষ্ঠান যদি সরকারি নিয়োগবিধি না মেনে নিয়োগ দেয়, তাহলে সেই নিয়োগ অবৈধ হবে কি না— জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস রুলস থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তারপরও সরকারের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা কিছু আইন করে। সেই আইনগুলো কিন্তু সরকারি মূল আইনের পরিপন্থি হবে না। যেখানে আইন নাই, সেখানে যদি সরকারের আইন অনুসরণ না করে, তবে সেটি অবৈধ। যে কেউ এটি আদালতের দৃষ্টিতে আনলে বিষয়টি বন্ধ হয়ে যাবে।
উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে জানানো হয়েছে, বিধিবহির্ভূত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত জনবলের চাকরি চূড়ান্তকরণ, শ্রান্তি বিনোদন, ভবিষ্যৎ তহবিল অনুমোদন, যোগদানকালীন দুটি বেতন বৃদ্ধি; সর্বোপরি জ্যেষ্ঠতা প্রদানসহ কোম্পানির সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অতি সম্প্রতি তড়িঘড়ি করে এসব প্রার্থীর চাকরি চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং বর্তমানে ডিএমটিসিএলের চাকরি বিধিমালায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে
‘তবে, আরেকটি কথা আছে। তারা যদি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পারমিশন নিয়ে থাকে তবে আলাদা কথা। অনেক সময় এমনও হয় যে, ওই নির্দিষ্ট বয়সে অভিজ্ঞ লোক পাওয়া যায় না; তখন কোনো কারণ দেখিয়ে যদি পারমিশন নিয়ে থাকে তবে সেটি বৈধ। কিন্তু পারমিশন না নিলে তা অবৈধ।’
চাকরি স্থায়ীকরণ সমস্যা নিয়ে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেন, এ সমস্যা নিরসনের জন্য অতিরিক্ত সচিব মো. আছির উদ্দীন সরদারকে প্রধান করে একটা কমিটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তাদের আরও কিছু দাবি-দাওয়া আছে। কমিটি এসব বিষয় নিয়ে শুনানি করেছে। ইতোমধ্যে কমিটির তিনটি সভা হয়েছে, আরও হবে। এসব সভায় কর্মকর্তাদের আরও যেসব দাবি-দাওয়া আছে সেগুলো শোনা হবে। ওনাদের সুপারিশ আসলে তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
সার্ভিস রুলস নিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এটি নিয়েও একটি কমিটি করা হয়েছে। ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে এ বিষয়ে জানাতে বলা হয়েছে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ডিএমটিসিএলের বোর্ডে এটি উপস্থাপন করা হবে।’
Leave a Reply