1. [email protected] : admin :
  2. [email protected] : editor :
  3. [email protected] : moshiur :
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:২০ পূর্বাহ্ন

পণ্যবাহী ট্রাকে উত্তরের পথে পথে চাঁদাবাজি

মহানগর রিপোর্ট :
  • প্রকাশের সময় : শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
  • ১১৭ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে গেল সপ্তাহেই খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদাবাজি বন্ধে দু’দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। তবু উত্তরাঞ্চলের পথে পথে পণ্যবাহী ট্রাকে রাখঢাক ছাড়াই চলছে ‘সরব’ চাঁদাবাজি। অনেক ক্ষেত্রে পোশাকধারী পুলিশ সদস্য, কখনও পুলিশ পরিচয়ে তাদের দালাল পণ্যবাহী গাড়ি থেকে চাঁদা তুলছে। সমকাল অনুসন্ধান চালিয়ে এর সত্যতাও পেয়েছে। এ কারণে পণ্যমূল্যের লাগামহীন দাম কোনোভাবে বাগে আসছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত একটি ট্রাককে ১৪ স্থানে ৫  হাজার ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। সঙ্গে রয়েছে ‘মান্থলি’ চাঁদা। সৈয়দপুর উপজেলা শহর হলেও জেলা সদরের চেয়েও ব্যস্ত। পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে বাইপাস সড়ক রাতভর থাকে জমজমাট। ট্রাকে মালপত্র তোলা হয় রাতে। সকালে সেগুলো যাত্রা করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। গত মঙ্গলবার সকাল ৯টায় আলুবাহী ট্রাকে চড়ে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে ব্যবসায়ী পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন এ প্রতিবেদক।

দেখা গেল, ৪-৫ জন পোশাকধারী পুলিশ দাঁড়িয়ে। ট্রাক থামালে এক পুলিশ সদস্য জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। ২০০ টাকা চাই তার। বলল, ‘বউনি হয়নি। মালপানি ছাড়।’ ২০০ টাকা দিয়ে ট্রাক নিয়ে সামনে এগোলেন তাজুল। বললেন, ‘চাঁদা না দিয়ে কখনও এই চৌরাস্তার মোড় পার হতে পারি না। খুব ছ্যাঁচড়া এরা। ১০০ টাকা হলেও নেবে।’

সকালের ফাঁকা রাস্তায় বাড়ে ট্রাকের গতি। ছুটছে তারাগঞ্জ উপজেলা হয়ে ইকরচালী বাজারের দিকে। কিছুটা এগিয়ে বালাবাড়ী হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি তল্লাশি চৌকি। সেখানে পুলিশ সদস্যরা হাত তুলে দিল গাড়ি থামানোর সংকেত। তাজুল জোর গলায় বললেন, ‘মালটির গাড়ি।’ শুনে বাধা দিল না তারা।

‘মালটি’ কী– প্রশ্নে তাজুল বললেন, এ হলো সড়কে যাতায়াতের মাসিক চুক্তি। বিভিন্ন এলাকা পুলিশ ইজারার মতো বিক্রি করে। এতে লেনদেন ডিজিটাল। নির্দিষ্ট নম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা পাঠাতে হয়। ট্রাকপ্রতি মাসে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা। একেই বলে মালটি। তাজুলের বক্তব্যে বোঝা গেল, শব্দটি আসলে মালটি নয়; মান্থলি।

অর্থাৎ ট্রাকটি মাসকাবারি চাঁদা দিয়েছে। এক মাসের জন্য বালাবাড়ী হাইওয়ে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে আর আটকাবে না ট্রাকটি। তাজুল জানালেন, মান্থলির টাকা মহাজন দেন।

বালাবাড়ী হাইওয়ে পুলিশ তল্লাশি চৌকির পর ট্রাক চলে দ্রুত লয়ে। একটানে চলে আসে পাগলাপীর বাজার এলাকায়। সড়কে যানজট নেই, তবে ট্রাকের গতি কমিয়ে দেন চালক। দেখা গেল, লাঠি হাতে ৪-৫ জন পুলিশ। তারা চালককে নামতে বলছে। তবে তাজুল সিটে বসে ১০০ টাকার তিনটি কড়কড়ে নোট ধরিয়ে দিতেই এগিয়ে যাওয়ার সংকেত পেলেন। তাজুল বললেন, ‌ভাগ্য ভালো। আজ ৩০০ টাকায় ছাড়া পেয়েছি; অন্যদিন ৫০০ নেয়।

গাড়ি ছুটছে রংপুর শহরের দিকে। শহর পার হয়ে নার্সিং কলেজ এলাকায় পুলিশ সার্জেন্ট ট্রাক থামানোর সংকেত দিলেও উপেক্ষা করে এগিয়ে যান তাজুল। একইভাবে মেডিকেল মোড় হয়ে সিটি বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে বাইপাস হয়ে মডার্ন মোড়ে আসে ট্রাক। সেখানে অপেক্ষমাণ সার্জেন্টদের হয়ে ‘কলার বয়’ এগিয়ে আসে। কথা বলার পর ৩০০ টাকা দিতে হলো।

গাড়ি চলছে এবার রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে। শঠিবাড়ী এলাকায় আসার পর দূর থেকে মনে হলো, পুলিশের তল্লাশি চলছে। তাজুলের ভাষ্য, তল্লাশি আসলে নাটক। মিথ্যা অজুহাতে ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায়ের ফন্দি। সেখানে ওভারব্রিজের নিচে আয়েশ করে বসে থাকা পুলিশ সদস্যদের দিতে হলো ৫০০ টাকা। এর পর বড়দরগা হাইওয়ে ফাঁড়ির তল্লাশি চৌকিতে ২০০ টাকা, পলাশবাড়ী মোড়ে জোরজবরদস্তি করে ৫০০ টাকা আদায় করল পুলিশ। টাকা না দিলে গাড়ি আটকের রেকার নিয়ে বসে আছে তারা।

গোবিন্দগঞ্জ এসে ফের তল্লাশি! গাড়ি থামিয়ে ট্রাকের কাগজপত্র নিয়ে নিচে নামলেন তাজুল। কিছুক্ষণ পর অস্থায়ী পুলিশ বক্স থেকে ফিরে জানালেন, এখানকার পুলিশ সদস্যরা কিছুটা ‘সৎ’। তারা চাঁদার টাকা হাত পেতে নেয় না। টেবিলের খোলা ড্রয়ারের মধ্যে ফেলে দিতে হয়। দূর থেকে যে কেউ দেখলে ভাববে, কাগজ যাচাই শেষে ছেড়ে দিচ্ছে। তবে ড্রয়ারে রাখতে হচ্ছে ৫০০ টাকা।

গাড়ি চলতে চলতে দুপুর ২টা বাজল। খাবারের বিরতিতে থামতে হলো পথের পাশের ভাতের দোকানে। বিস্তারিত কথা হয় তাজুলের সঙ্গে। জানালেন, মাসে ১৫টি ট্রিপ নিয়ে ঢাকা যান। কোথায় কী হয়, কীভাবে পুলিশের লোক দেখানো তল্লাশি থেকে ছাড়া পেতে হয়, সব মুখস্থ। টাকা না দিলে পুলিশ হয়রানি করে; মামলা দেয়। ট্রাকচালক ও গাড়ির মহাজনরা নিরুপায়। ব্যবসা করলে এসব মেনে নিয়েই তা করতে হবে।

আবার রওনা। পথ এখন বগুড়ার সীমানা ধরে। এখানে মোকামতলা এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকি থাকলেও সেদিন কেউ সড়কে ছিল না। তবে বিপত্তি ঘটল গোকুল এলাকায়। সেখানে মহাসড়কে কাগজপত্র পরীক্ষার নামে একের পর এক ট্রাক থামাচ্ছে পুলিশ। মামলাও দিচ্ছে। তাজুলের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। গাড়ি থেকে নেমে বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানালেন, সবই ঠিক আছে। তার পরও ৬০০ টাকা দিতে হলো। তাদের দাবি ছিল ১ হাজারের। হাতে-পায়ে ধরে ৪০০ কমিয়েছি। গাড়ি স্টার্ট করে তাজুল জানালেন, বগুড়ার দ্বিতীয় বাইপাস ব্যবহার করবেন। কারণ প্রথম বাইপাসে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়।

চাঁদা কোথায় কীভাবে আদায় হয়, তা দেখতেই যাত্রা। তাই প্রতিবেদকের অনুরোধে বাইপাস দিয়ে যেতে রাজি হলেন তাজুল। মাটিডালি চারমাথা হয়ে বনানীর দিকে গাড়ি ছোটে। এই পথে পূর্বনির্ধারিত দুটি পয়েন্ট চারমাথা ও ভবেরবাজারে টাকা দিতে হলো না। সেখানে নাকি কিছুদিন আগে র‍্যাব অভিযান চালিয়েছে। চাঁদাবাজরা কেউ বের হচ্ছে না।

গাড়ি তিনমাথা রেলগেট পার হওয়ার সময় ওত পেতে থাকা পুলিশ সদস্যরা অতিরিক্তি মালপত্র পরিবহনের অভিযোগে রেকার বিল ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিল ‘কলার বয়’কে দিয়ে। শর্ত দেওয়া হলো– ১ হাজার টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। পুলিশকে ৫০০ আর কলার বয়কে ১০০ টাকা দিয়ে নিষ্কৃতি মিলল।

গাড়ি ছুটছে এবার বগুড়া-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কে। এই পথে বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের পাহারা থাকলেও কেউ সংকেত না দেওয়ায় গাড়ি থামাতে হয়নি। বিপত্তি বাধল হাটিকুমরুল মোড়ে। সেখানে গাড়ি থামিয়ে নেওয়া হলো ৫০০ টাকা। উত্তরবঙ্গের পথ শেষ হলো।

যমুনার বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে ট্রাক প্রবেশ করে টাঙ্গাইলে। সেখানে পুলিশ চাঁদা আদায় করে নতুন কায়দায়। কাগজপত্র ঠিক থাকলে এক রেট, না থাকলে আরেক। রেকার লাগালে সেই বিলের সঙ্গে অতিরিক্ত জরিমানা ও দালালদের স্পিডমানি দেওয়ার অলিখিত নিয়ম করা হয়েছে। যমুনা সেতুর গোলচত্বরে পুলিশ সদস্যরা তাজুলের ট্রাকের সব কাগজ নিয়ে নেয়। এখানে দিতে হলো ৮০০ টাকা। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে তাজুল বললেন, ‘আর একটু পর আসলে এই ধরাটা খাইতাম না। এরা বেশি রাতে থাকে না।’

অন্ধকার হয়ে এলো সেতু পার হতে। সংযোগ সড়ক ধরে ট্রাক প্রবেশ করল এলেঙ্গায়। পুলিশের পরিচয় দিয়ে ‘কলার বয়’ নিল ২০০ টাকা। গাড়ি এবার টাঙ্গাইল-ঢাকা মহাসড়কে। দ্রুতগতিতে চলছে। রাত সাড়ে ১০টায় চন্দ্রার মোড়ে আবারও গতি কমে গেল। সেখানে পুলিশের লোক পরিচয়ে এক ব্যক্তি নিল ৩০০ টাকা। ঢাকা-বাইপাস হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তায় আরেক দল নিল ২০০ টাকা। মীরেরবাজারে আবার থামানো হলো কাঁচপুর ব্রিজের ঢালে। একইভাবে সেখানেও দিতে হলো ২০০ টাকা। এর পর গন্তব্য শেষ হলো গাউছিয়া হয়ে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। বেশি রাত না হলে এখানেও একাধিক টিম অপেক্ষায় থাকত বলে জানালেন চালক তাজুল।

মহাসড়কে পুলিশের চাঁদাবাজি বিষয়ে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বলেন, সব সময় সতর্ক নজর রাখছি। সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চাঁদা বন্ধে। এর পরও হয়তো দু-একজন এ কাজটি করে থাকতে পারে। গোয়েন্দা দিয়ে তদন্ত করছি। যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থেকে পুলিশ মাসিক চুক্তিতে চাঁদা নেয় মান্থলির নামে– তা সবাই জানে। সরকারের একাধিক সভায় তা উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছি। কাজ হয় না।

হাইওয়ে পুলিশের বগুড়া জোনের সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, আমি সাদা পোশাকে প্রায়ই মহাসড়কে ঘুরি। কোনো পুলিশ সদস্য যাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত না হয়, সে জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছি। এর পরও কেউ এ কাজে জড়িত থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উত্তরবঙ্গ ট্রাক মালিক-শ্রমিক যৌথ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকার বলেন, আগে শ্রমিকরা কিছু পয়েন্টে চাঁদা তুললেও এখন সব বন্ধ। ফাঁকা মাঠে পুলিশ নিজেরাই চাঁদাবাজিতে নেমেছে। অনেক মালিকই এ নৈরাজ্যের শিকার। এমনকি পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তি করে অনেকে ট্রাক চালাতে বাধ্য হচ্ছে। এটা করা না হলে নানা রকম মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

টাকা উঠছে অদৃশ্য চুক্তিতে

আগে পুলিশের চাঁদা আদায়ের ধরন ছিল টোকেন বা কার্ড দিয়ে পুরো মাসের চাঁদা তুলে নেওয়ার। এখন মহাসড়কে চাঁদাবাজি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাসিক চুক্তির টাকা পরিশোধ করে ট্রাক মালিকরা। পুলিশ ট্রাক আটকানোর পর টাকা পাঠানোর ফোন নম্বর দিয়ে কল করলে ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে পুলিশের কাছে মান্থলিতে থাকা কিছু ট্রাকের নম্বর পাওয়া যায়। মাসে ১ থেকে ৩ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো- ১৫-**৫৯, ১৩-**১৮, ১৮-**৮৯, ১৩-**৫৬, ১৩-**৫৪, ১৭-**৪৪, বগুড়ার ১১-**৬২, ১৫-**১৬, ১৫-**৭০, ১১-**২০, ১৮-**২৯, পাবনার ১১-**৬৫, ১৫-**৯৪, ১৩-**২৫, ১১-**৯৪, নরসিংদীর ১১-**২৮, ১৪-**৪৩, ১৫-**৪৫, ১৩-**৫২, ১১-**৫৪ নম্বরের ট্রাকগুলো রয়েছে (ট্রাক মালিকদের নিরাপত্তার কারণে পুরো নম্বর প্রকাশ করা হয়নি)।

চুক্তিতে চলা ট্রাকগুলোতে ফুল-ফল ও পাখির নাম-সংবলিত একটি কোড বলে দেওয়া হয়। গাড়ি আটকালে কোডটি বললে ছেড়ে দেন সার্জেন্টরা। আবার কখনও সন্দেহ হলে তারা মোবাইল নম্বর যাচাই করেন। পুলিশ এই টাকা সরাসরি সংগ্রহ করে না; নির্ধারিত কলার বয়ের মাধ্যমে একাধিক মোবাইল নম্বরে নেয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়ে বলেন, সবাই এ টাকার ভাগ পায়। না হলে এভাবে চাঁদাবাজি সম্ভব হতো না।

সূত্র: সমকাল

এই সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: সিসা হোস্ট