বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ হচ্ছে। ১৪টির মতো মর্টার শেল ও গোলা এসেছে পড়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব বাহিনী ও সংস্থা সতর্ক অবস্থায় থাকলেও সীমান্তে আতঙ্ক কাটেনি। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও আরাকান বিদ্রোহীদের মধ্যে সৃষ্ট এ সংঘাতের জেরে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তবে এই আশঙ্কার সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
এদিকে গোলাগুলির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত এলাকার পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চবিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে গত রবিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানান, রাখাইনে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে অস্ত্রবিরতির জন্য বেইজিং মধ্যস্থতা করছে। রাখাইনে অস্ত্রবিরতি প্রতিষ্ঠা হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ত্রিরতন চাকমা বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে গোলাগুলির কারণে ধুমধুম সীমান্ত এলাকার বাইশ ফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ গুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করা ঘোষণা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকবে বলে জানান তিনি।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফরিদুল আলম হোসাইনি জানান, গোলাগুলির কারণে ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ওই সময়ে রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা থেকে যান। তারা সেখানে এতদিন অনেকটা নিরাপদে ছিলেন। তবে গত বছর থেকে রাখাইনে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষ শুরু হলে তারা অনেকটা বেকায়দায় পড়ে যান।
মিয়ানমারের ওপারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে রাখাইনের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদের ওপারে এসে অবস্থান করছেন। বিশেষ করে সীমান্তের ওপারে মাংগালা, রোহিঙ্গা ঢং ও প্রাংপুরে অনেকে অপেক্ষা করছেন। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে তারা নাফ নদ দিয়ে বাংলাদেশের দিকে চলে আসবেন। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্তের ওপারে নলবনিয়া ও কিলাইঢং এলাকায় বেশকিছু রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। তমব্রু সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বিজিবি সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে গত কয়েকদিনে রাখাইনের সংঘাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারী অস্ত্রের গোলা এসে পড়ার পর গত রবিবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক একেএম নাজমুল হাসান সীমান্ত পরিদর্শন করেন। তিনি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এরপর থেকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বিজিবি সদস্যদের কড়া পাহারায় দেখা গেছে।
টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, মহাপরিচালকের নির্দেশনামতো সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতায় বিজিবি দায়িত্ব পালন করছেন। সীমান্তে অনুপ্রবেশসহ যে কোনো ধরনের অপরাধ দমনে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের মর্টারশেল আমাদের দেশে এসে পড়েছে। আমরা নজর রাখছি। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও সতর্ক আছে। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগে আছি। আমরা আশা করব, আর কোনো মর্টার শেল আমাদের দেশে পড়বে না।’
টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলম বাহাদুর বলেন, ২০১৭ সালে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। এত বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রভাবে আমরা স্থানীয়রা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের খাদ্য, নিরাপত্তা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে রোহিঙ্গারা। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে যেন না ঢোকে, সেটাই আমাদের দাবি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, সীমান্তের পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছুটি দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তুমব্রু পশ্চিমকুল এলাকায় সীমান্তের ওপারে গতকাল সকাল থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী ও আরকান আর্মির সঙ্গে লড়াই চলতে থাকে। মর্টারের একটা অংশ এসে পড়ে স্থানীয় বাহাদুল্লাহর বসতভিটায়।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সংঘর্ষ চলমান রয়েছে, তাই পরিষদের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সীমান্তের কাছাকাছি না যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মাসরুকী জানান, সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।
Leave a Reply