হিরো আলম কি প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় চপেটাঘাত করলেন? পরাজয়ের পর তিনি প্রশাসনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বললেন, ‘জিতলে স্যার ডাকতে হতো, তাই হারিয়ে দেওয়া হলো। ’ এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হইচই ফেলে দিয়েছে।
সৃষ্টি করেছে তোলপাড়। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটার আগামাথা বুঝি না।
আজ জুতার মালা, কাল দিচ্ছে ফুলের মালা। দুই দিন আগে ছিল হিরো আলমের সমালোচনা, এখন প্রশংসা।
করোনার পর একটা অস্থিরতায় ভুগছি আমরা। অসুস্থতা কি না জানি না। মানুষের মন বদল হয়েছে। চিন্তায় এসেছে পরিবর্তন। খারাপ কিছু নিয়ে মাতামাতি হয় বেশি। ভালোকে সবাই পথ মাড়িয়ে চলে। কয়েক মাস আগের কথা। কলকাতায় এক আড্ডায় কথায় কথায় একজন বললেন, দাদা আপনাদের ওখানে একজন নায়ক আছেন না? তিনি নাকি অনেক জনপ্রিয়। অবাক চোখে তাকালাম। বুঝতে পারলাম না কী বোঝাতে চাইছেন। কার কথা বলছেন। ভেবেছিলাম শাকিব খানের কথা হয়তো বলছেন। কলকাতায় শাকিব বেশ আলোচিত। একটু পর তিনি বললেন, আরে দাদা বুঝলেন না, হিরো আলমের কথা বলছি। এবার বুঝলাম, বাংলাদেশের অভিনয়ের মান বোঝাতে একটু কটাক্ষ করছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে হিরো আলম কলকাতায়ও বেশ আলোচিত। আমাদের সুশীল সমাজের মতো ওখানেও সবাই তাকে নিয়ে কটাক্ষ করেন। মজার আলোচনা করেন। সাধারণ মানুষ তার ভিডিও দেখে মজা নেন। মাতামাতি করেন। কলকাতার বন্ধুকে বললাম, বাংলাদেশের অনেক নায়ক কলকাতায় জনপ্রিয়তা নিয়ে আছেন। তাদের কথা বলছেন না কেন? একটা সময় রাজ্জাক অভিনয় করেছেন। আলমগীর অনেক ছবিতে পুরস্কার পেয়েছেন। এখন শাকিব খানের বিলবোর্ড তো আপনাদের অনেক স্থানেই দেখছি। ফেরদৌসের ছবির সংখ্যাও পশ্চিমবঙ্গে কম নয়। জয়া পশ্চিমবঙ্গ কাঁপিয়ে এখন মুম্বাই পাড়ি দিচ্ছেন। তার সব ছবিই আপনাদের এখানে সফল। শুধু হিরো আলমকে নিয়ে আলোচনা করলে হবে দাদা? তার পরও শুনে ভালো লাগছে, হিরো আলমও কলকাতার বাজারে কোনো না কোনোভাবে আছেন। হইচই ফেলে দিয়েছেন। পজিটিভ-নেগেটিভ আলোচনায় নাইবা গেলাম। ভদ্রলোক এবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, মজা করছি। আপনি সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? আসলে কি জানেন, হিরো আলম, কাকলি ফার্নিচারের বিজ্ঞাপন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ট্রল হয়। আমারও চোখে পড়েছে। তাই আলাপ করলাম। অন্য কিছু নয়। এ নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। এ ঘটনার কিছুদিন পর ঢাকায় দেখলাম, পুলিশ হিরো আলমকে আটক করল। নির্দেশ দিল তার অভিনয়ের ভাষা ঠিক করতে। বিস্মিত হয়েছিলাম। অভিনয়ের আবার ভাষা থাকে নাকি!
সমাজ যেদিকে ধাবিত হবে হিরো আলম তার বাইরে যাবেন কী করে? রুচির দুর্ভিক্ষের যুগে মানুষের বিনোদন হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের গালাগাল আর খিস্তির ভিডিও দেখা। যার যা মন চাইছে তা-ই বানাচ্ছে। তারপর ছেড়ে দিচ্ছে বাজারে। কোথাও দেখার কেউ নেই। নিয়ন্ত্রণ নেই। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর কীভাবে সব সামলাচ্ছে, সেদিকে গেলাম না। রেজিমেন্টাল দেশ চীন নিয়ে আলাপের দরকার নেই। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও ইউটিউব, ফেসবুক থেকে সরকার চাইলে অসুস্থ ভিডিও সরিয়ে নিতে পারে। কীভাবে সম্ভব হয়েছিল জানেন, তারা কিছু দিনের জন্য ইউটিউব, ফেসবুক বন্ধ রেখেছিল। ব্যবসা বন্ধ তাই সংশ্লিষ্টদের বড় কর্তারা ভারত এলেন। বসলেন সরকারি আমলাদের সঙ্গে। রাজনীতিবিদদের সাক্ষাৎই পেলেন না চেষ্টা করে। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দিল্লি, কলকাতাসহ অনেক শহরে অফিস করতে হয়েছে ইউটিউব, ফেসবুককে। এখন আর যা খুশি তা করা যায় না। বাংলাদেশে এভাবে অবাধ অবস্থান কীভাবে নিয়ে আছে, সরকার কেন পারছে না জানি না। এখন আর অনেক কিছু নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। এক জীবনে অনেক কিছুই দেখলাম। আমাদের সুস্থধারার সংস্কৃতি শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। জেলা, উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমির ভবন আছে। অনুষ্ঠান নেই। রাজনীতিবিদরা এসব নিয়ে ভাবেন না। প্রশাসন দায়িত্বের বাইরে যায় না। সবাই সবকিছু পাশ কাটিয়ে শুধু সময়টা অতিবাহিত করছে।
একটা সময় গ্রামগঞ্জে যাত্রা হতো। ছিল পালাগান। ঢাকা থেকে প্রিন্সেস লাকি খানেরা যেতেন মফস্বলে। শীতকালে মুখ চাদরে ঢেকে ছেলে-বুড়ো একসঙ্গে প্রিন্সেসদের নাচ দেখত। বেসুরো গলার গান শুনত। দল বেঁধে যেত সার্কাস দেখতে। বৈশাখী বা শীতকালীন মেলায় থাকত পুতুলনাচ। ওয়াজ মাহফিলের কমতি ছিল না। যার যেখানে ভালো লাগত সেখানে যেত। কেউ কোনো আয়োজনের বিরোধিতা করত না। এখন কোনো কিছু নেই। শহরে আমাদের খেলার মাঠগুলো হারিয়ে গেছে। গ্রামের ছেলেরা খেলার মাঠে যায় না। কাজকর্ম বাদ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১০ টাকায় সাপ-লুডুর জুয়া খেলে। কেউ দেখে হিরো আলমের নাচগানের ভিডিও। কেউ শোনে বিদেশে বসে বানানো খিস্তির ভিডিও। হিরো আলম নিজের অর্থ আয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন। অন্যরা যখন ব্ল্যাকমেইল, দেশ, সমাজবিরোধী ভিডিও বানায়, তখন হিরো আলম তার মতো করে বিনোদন ভিডিও তৈরি করছেন। তার কাজগুলোকে খারাপভাবে বগুড়ার মানুষ দেখেননি। আর দেখেননি বলেই তাকে ভোট দিয়েছেন। তীব্র লড়াই করে তিনি একটি আসনে হয়েছেন দ্বিতীয়। আরেকটিতে তৃতীয়। টানটান উত্তেজনার ফলাফলে হেরেছেন মাত্র ৮৩৪ ভোটে। এ ফলাফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্ত অবস্থান তার দিকে। কেউ লিখছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের শিক্ষা দিলেন হিরো আলম। জানিয়ে দিলেন, বিশাল নেতা সেজে অহংকার করা চলবে না। ভোটারদের কাছে যেতে হবে।
হিরো আলমের ফলাফলের রাতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তিনি বললেন, বগুড়ায় এটা কী হলো? এরপর তিনি বললেন, জাসদের মশাল নিয়ে ভোট করার শখ এবার মিটলেই হয়। তাদের জন্য এ ভোট বিরাট বার্তা দিয়ে গেল। নৌকা না পেলে তাদের কোনো অবস্থানই নেই ভোটের মাঠে। শুধু বড় বড় কথা। জবাবে বললাম, সাধারণ ভোটাররা এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। আগামী জাতীয় সংসদের ভোট দুটি প্রতীকের লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। জোট-মহাজাটের প্রার্থীর প্রতীকের সমীকরণ বদলে গেল। এখন একদিকে নৌকা প্রতীক ছাড়া চলবে না। অন্যদিকে ধানের শীষের কদর বাড়ল। কঠিন বার্তা এলো জোট-মহাজোটের প্রার্থীদের জন্য। সংসদে যাওয়াকে বড্ড বেশি সহজতর বিষয় মনে করছিলেন অনেকে। সেদিন আর থাকল না। কাহালু-নন্দীগ্রাম জানিয়ে গেল, যতটা ভেবেছিলেন এমপি হওয়া বাস্তব অনেক কঠিন। যে কেউ চ্যালেঞ্জ নিতে পারে। মাঠ খালি থাকবে না। এলাকার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে এমপি হওয়া যাবে না। ঢাকায় বসে সংবাদ সম্মেলন আর প্রেস রিলিজের রাজনীতি আমজনতাকে প্রভাবিত করে না। মার্কা ও প্রার্থী দুজনকে মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে। স্লোগানের রাজনীতির দিন শেষ। দরকষাকষি করে এতদিন প্রতীক নেওয়ার একটা কৌশল ছিল ছোট দলগুলোর। বগুড়া অনেক কিছুই জানিয়ে দিয়ে গেল। অনেকে হিরো আলমের প্রার্থিতাতে জাত গেল ভাব দেখাচ্ছেন। কেউ প্রশ্ন করছেন, হিরো আলম কি আইনপ্রণেতা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? এ যোগ্যতা অতীত-বর্তমানে অনেকের ছিল না। এখনো নেই। তার পরও সবাই সংসদে যান। তারা পুতুলের মতো বসে থাকেন। আইন প্রণয়নের সময় কথা বলেন না। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেন না মতামত। অনেকে যান না নির্বাচনী এলাকায়। জনগণকে দেন না সময়। কেউ ভাবেন আইনপ্রণেতাদের কেন এত কিছু করতে হবে?
আমেরিকার মতো দেশেও কংগ্রেসম্যানরা নির্বাচনী এলাকায় সময় দেন। জনগণের জন্য রাখেন নির্ধারিত সময়। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ছাড়াও কংগ্রেসম্যানদের নিজের নির্বাচনী এলাকায় অফিস থাকে। সেই অফিসে একটা টিম থাকে। সেই টিম প্রতিদিন মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শোনে। ব্যবস্থা নেয়। আমার মেয়ে একজন কংগ্রেসম্যানের অফিসে ইন্টার্ন করেছিল। মেয়ে বলল, বাবা, মাঝে মাঝে ফোন করে মানুষ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা নিয়ে কংগ্রেসম্যানকে গালি দেয়। সেই গালি ফোন যারা ধরে তাদের শুনতে হয়। ছোটখাটো বিষয়েও ফোন আসে। কারও দরকার বাড়ি ভাড়া, কেউ চান হাসপাতাল বা স্কুলে সন্তানের ভর্তি। সব ফোন কংগ্রেসম্যানের অফিস রিসিভ করে। পার্লামেন্টে ব্যস্ত থাকলে ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন কংগ্রেসম্যানরা। কিন্তু তাদের অফিস খোলা থাকে। অফিসের ফোন ঠিক থাকে। লোকজনের আনাগোনা থকে। রাজনীতির চিত্র সবখানে এক। বাংলাদেশে সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের বাড়িতে ভোর থেকেই ভিড় থাকে আমজনতার। বামধারার রাজনীতিবিদের কথা আলাদা। তারা বিশ্বাস করেন, শুধু বক্তৃতা আর সভা-সেমিনারে বিপ্লব আসবে। ব্যবসায়ী এমপিরা মনে করেন নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার দরকার নেই। ২০১৪ ও ’১৮ সালের ভোট কাউকে কাউকে গণবিমুখ করেছে। বাড়িয়েছে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব। জোট ও মহাজোটের শরিকরাও একই। তারা চান শুধুই ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা। ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব তাদের বিজয়ী করা। কথামালা আর বক্তৃতাবাজির ওপরই আঘাত বগুড়ায়। হিরো আলম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছেন। এ বাস্তবতা মানতে হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে মানুষের ভোটকে সম্মান জানাতে হবে। অযথা সমালোচনা করে লাভ নেই। মশালের করুণ হাল নিয়ে ভাবুন। এ নিয়ে আমেরিকান প্রবাসী বন্ধু আতিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, একজন হিরো আলম তো দেখিয়ে দিলেন। পুরো একটা সন্ধ্যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মীদের রাখলেন টানটান উত্তেজনায়। অনেক রাজনীতিবিদ হিরো আলম আতঙ্কে মন খারাপও করলেন। সুশীলরা হলেন অস্থির। সংসদে হিরো আলম চলে এলেন কি না এই টেনশনও ছিল। জবাবে প্লেটোর একটা কথা শোনালাম। প্লেটো বলেছেন, ‘মানুষ যেমন হবে রাষ্ট্রও তেমনি হবে। মানুষের চরিত্র দ্বারাই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ’ হিরো আলমের ভোট আলাদা কিছু নয়।
হিরো আলমের এত ভোট প্রাপ্তিকে সমাজ ও রাজনীতির প্রতি চপেটাঘাত মনে করি না। কঠিন বাস্তবতা হিসেবে দেখি। এ বাস্তবতা অতীতেও অনেকবার বেরিয়ে এসেছিল আমাদের সমাজে। রাজনীতিবিদরা ভুল করলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এরশাদ জমানায় একজন ছক্কা ছয়ফুর এভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন। সিলেট সদর উপজেলায় জয়ী হয়ে তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ইফতেখার হোসেন শামীমের মতো প্রভাবশালী নেতা দাঁড়িয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে শামীম পরাজিত হন। জয়ী হন ছয়ফুর রহমান। তখনকার ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিও হালে পানি পায়নি। সাদামাটা মানুষ ছয়ফুর জীবিকা নির্বাহ করতেন ঠেলাগাড়ি চালিয়ে। তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করতেন। ভোটে দাঁড়ানোই ছিল নেশা। উপজেলা নির্বাচনে সাধারণ মানুষ চাঁদা তুলে খরচ যুগিয়েছিল। অনেক বছর পর এলেন হিরো আলম। হিরো আলম শুরুতে ভোটের মাঠে ঠিকভাবে থাকতে পারেননি। তার প্রথম সপ্তাহ কেটেছে প্রার্থিতা ঠিক রাখতে আইন-আদালতে। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাঠে। দুটি আসনে দাঁড়িয়েছিলেন। ভোটের প্রার্থনায় দুই আসনে ঘোরাঘুরি করলেন। মানুষের কাছে গেলেন। তার দল ছিল না। কর্মীবাহিনী, মোটরসাইকেলের দাপট ছিল না। মূলধারার মিডিয়া দেয়নি গুরুত্ব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রথম করল হাসিঠাট্টা। টাকার পাহাড় ছিল না। তিনি ব্যাংক লুটেরা ছিলেন না। দুর্নীতি, অনিয়ম, টাকা পাচার করেননি। অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির অভিযোগ নেই। সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করেননি। নিজের সরলতা আর বাস্তবতাকে পুঁজি করেই ভোট করলেন। মানুষ তাকে ফেরাল না। প্রাপ্ত এই ভোটকে সম্মান দিতে হবে। গণতন্ত্রে সবই সমান।
লেখক : নঈম নিজাম,সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
Leave a Reply