ঈদের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী শনিবার বা রোববার উদযাপিত হবে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে নানা বিড়ম্বনা সয়েও ঘরমুখো মানুষের ঢল নেমেছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে।
শুধু কোনো রকমের পা রাখার জায়গা পেলেই লঞ্চে চড়েছেন যাত্রীরা।
বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) সদরঘাট ও এর আশেপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গার্মেন্টস ছুটি হওয়াতে এদিন অন্যদিনের তুলনায় ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড় বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নগরবাসীদের আসতে দেখা যায়। সকাল থেকেই সদরঘাটে ঘরেফেরা মানুষ আসতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে যাত্রীদের চাপ। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে সময়ের আগেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে লঞ্চ। এতে যাত্রীদের লঞ্চ ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে না হলেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে অনেক যাত্রীকে। সদরঘাট ও এর আশেপাশে তীব্র যানজটের কারণে অনেক যাত্রীকে গুলিস্তান থেকেই পাঁয়ে হেঁটে সদরঘাট নৌবন্দরে আসতে দেখা গেছে। এর সাথে তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন।
সকাল ছয়টা থেকে লঞ্চ ছাড়া শুরু হয়। যাদের লঞ্চ বিকেলে বা সন্ধ্যায়, তারা টার্মিনালে আসেন দুপুর ১২টার পর থেকে। তবে তিনটার পর থেকে যাত্রীদের চাপে পন্টুনে জায়গা না পেয়ে টার্মিনালের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের। র্টামিনাল, পন্টুন, লঞ্চে যাত্রী আর যাত্রী। পন্টুনে ভিড় থাকায় অনেককেই নৌকায় করে লঞ্চে উঠতে দেখা গেছে।
লঞ্চের যাত্রীদের হয়রানি রোধে নৌ-পুলিশের একাধিক দল নদীতে ও টার্মিনালে দায়িত্ব পালন করছে। টার্মিনাল এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব, কোস্টর্গাড, আনসার সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। মাঝনদী থেকে যাত্রীদের লঞ্চে ওঠা বন্ধে নৌ-পুলিশ তৎপর রয়েছে।
রাজধানীর করাইলের বাসিন্দা মো. সিহাব উদ্দিন বলেন, বাসা থেকে একটার পর রওনা হয়েছি, টার্মিনালে আসতে ৫টা বেজে গেছে। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। তাই গুলিস্তান এসে বাধ্য হয় পায়ে হেঁটে এসেছি। কিন্তু ভিড়ের জন্য লঞ্চে উঠতে পারিনি। এখন দাঁড়িয়ে আছি ভিড় কমলে লঞ্চে উঠবো।
আশুলিয়া থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে ভোলা যাবেন মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, আশুলিয়া থেকে ১২টায় রওনা দিয়েছি। এখানে পৌঁছেছি ৫টায়। সবাইকে নিয়ে একসাথে পন্টুনে উঠেছি। হঠাৎ দেখি মা ও বোন পিছনে নেই। এতো ভিড় তাদের হারিয়ে এখন টার্মিনালে দাঁড়িয়ে আছি। ফোন দিচ্ছি ধরছে না। তাদের সাথে যোগাযোগ হলে লঞ্চে উঠবো।
এমভি ফারহান-১০ এর যাত্রী মো. জামাল হোসেন বলেন, ভাই অনেক কষ্টে লঞ্চে উঠেছি। কোথায়ও জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে বারান্দায় বিছানা পেতেছি। কী করবো, পরিবার নিয়ে বাড়ি যাবো বাবা মায়ের সাথে ঈদ করবো। এর থেকে বড় শান্তি আর কি হতে পারে। নিরাপদে ও সময়মতো যেতে পারলেই এ সব কষ্ট আর কষ্ট মনে হবে না।
গাজীপুর থেকে এসেছেন মো. বাবুল হোসেন, বেতুয়া যাবেন। কিন্তু টার্মিনাল ও পন্টুনের ভিড় দেখে দেড় ঘণ্টা ধরে টার্মিনালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করতেই বলেন, বাবা-মা নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাবো। কিন্তু যে ভিড় এতে বাবা মাকে নিয়ে লঞ্চে ওঠা কষ্ট হবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি। ছোট ভাইকে লঞ্চে পাঠিয়েছি বিছানা পেতে জায়গা রাখার জন্য। ভিড় কমলেই লঞ্চে উঠবো।
টংগী থেকে ৫ ঘণ্টা যানজট ঠেলে সদরঘাট এসেছেন মো. সেলিম। যাবেন হাতিয়া। তিনি বলেন, রোজার রেখে গুলিস্তান থেকে পায়ে হেঁটে এসেছি। এত কষ্ট করে লঞ্চে উঠেছি কোথাও কোন জায়গা নেই। লঞ্চে উঠতে পেরেছি এটাই বড় কথা। গরমটা বেশি। আজকে অনেক ভিড়।
গার্মেন্টসে চাকরি করেন মো. সোহেল। তিনি জানান, কষ্ট হলেও পরিবারের সাথে ঈদ করার আনন্দ মিস করতে চান না তিনি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ডিউটি করে তিনি টার্মিনালে এসেছেন। যেভাবেই হোক বাড়ি যাবেনই।
এমভি ফারহান লঞ্চের ম্যানেজার মো. সালাম বলেন, আজকে বিকাল থেকে ভিড় বেশি। প্রতিটি লঞ্চ ফুল লোড হয়ে যাচ্ছে। আমরা না করলেও যাত্রীরা ঠেলে উঠে যাচ্ছে। তারা যেখানে জায়গা পাচ্ছে বসে পড়ছে। না করলেও কথা শোনে না। যেভাবেই হোক তাদের যেতে হবে।
ভাড়া নিয়ে অভিযোগের কথা বললে তিনি বলেন, আসলে ভাড়ার বিষয়টি হচ্ছে আমরা সরকার নির্ধারিত যে ভাড়া সে ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়ায় এতোদিন যাত্রী আনা নেওয়া করেছি। ঈদের সময়ও সেটা করছি। সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৬০০ টাকা, আমরা এখন ৫০০ টাকা নিচ্ছি। আর গড়সিজনে সেখানে ৪৫০ টাকা করে ভাড়া নিয়েছি। এখন সেটাকে যাত্রীরা ভাড়া বেশি বলছে।
এদিকে ঈদে অতিরিক্ত যাত্রীর ভিড়ে সদরঘাট টার্মিনাল থেকে শুরু করে আশে পাশের এলাকায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। গুলিস্তান, রায়সাহেব বাজার, জগ্ননাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, বাংলাবাজার, ইসলামপুর রোড, নয়াবাজার, বংশাল পর্যন্ত যানজটের কারণে যাত্রীদের পায়ে হেঁটে টার্মিনালে আসতে দেখা গেছে।
এমভি রাজহংস-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার জানান, তাদের লঞ্চের কেবিন ও সিট অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও লঞ্চে যাত্রীদের জায়গা হচ্ছে না। তবে ডেকের যাত্রীদের নগদে টিকিট দেওয়া হলেও অতিরিক্ত যাত্রী হওয়ায় অনেকেই টিকিট ছাড়াই লঞ্চে উঠে পড়েছেন। কারো কাছ থেকেই অতিরিক্ত কোনো ভাড়া নেওয়া হয়নি। যারা টিকিট ছাড়া উঠেছেন পরে তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হবে।
বিআইডব্লিটিএর ট্রাফিক সাব ইন্সপেক্টর এ রকিব মো. বলেন, সদরঘাট টার্মিনাল থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটে বিকাল ৬টা পর্যন্ত ৭২টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। এতে প্রায় এক লাখের মতো যাত্রী ছিলো। আরও ৪০টির মতো লঞ্চ অপেক্ষমান। এগুলো রাত ১২টার মধ্যে ছেড়ে যাবে। সকালে চাঁদপুর, বরিশাল, লালমোহন, মৃদ্ধারহাট, মুলাদি, বরগুনা, ভোলা, শৈলা ও শরিয়তপুরের লঞ্চ ছেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, দিনের তুলনায় রাতে বেশি যাত্রী নিয়ে সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়া হচ্ছে। এছাড়া লঞ্চ বেশি থাকার জন্য যাত্রীদের ওঠানামা করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপত্তায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। সার্বক্ষণিক মনিটরিং হচ্ছে। আশা করছি যাত্রীরা নিরাপদে ঈদ উদযাপন করতে পারবে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, ঢাকা নৌবন্দর থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৪৩টি রুটে এ বছর ঈদ করতে সদরঘাট হয়ে ঘরে ফিরবেন প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। বৈশাখ মাস হওয়ায় বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে বারবার মাইকিং করে নৌপথে চলাচলে কিছু সতকর্তার কথা বলা হচ্ছে।
Leave a Reply