টিকিট ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত দুদকের কর্মচারী এমদাদুল। অবসরে যাওয়ার পর যাতায়াত ভাড়ার সব টাকা ফেরত দিয়ে বাহবা পেয়েছিলেন তিনি। অথচ জেসমিন প্রধান নামের এক নারী পাঁচ বছর পর হঠাৎ লাখ লাখ টাকার কর সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে বাহবা তো পেলেনই না, উল্টো দুর্নীতির জালে ফাঁসলেন! কিন্তু কেন?
জানা যায়, আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে হঠাৎ ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষের প্রায় ২২ লাখ টাকা কর দিয়ে ওই নারীর নামে তড়িঘড়ি রিটার্ন দাখিল করা হয়। আয়কর নথিপত্র ঘষামাজা করা, পুরোনো চেক ভুলবশত জমা না হওয়ার নাটক এবং মূল রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমাও দেওয়া হয়। এরপরও চাপা থাকেনি জালিয়াতি।
অনুসন্ধানে এই জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রমাণ পেয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান কর্মকর্তারাও। এনবিআরের কর অঞ্চল-৮ এ ঘটে যাওয়া এমন ঘটনায় দায়িত্বে থাকা উপ-কর কমিশনার খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী হিরেশ লাল বর্মণের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
দেশের স্বার্থ ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে করদাতার কাছ থেকে কর আদায় করেছি। তার পরিচয় সম্পর্কে অবগত নই। এখানে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। দুদক যদি মামলা করে তাহলে তা আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবেঅভিযুক্ত উপ-কর কমিশনার খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম
অন্যদিকে, দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মশিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। যদিও সংস্থাটির অপর উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, যেকোনো দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান, দুদকের একটি চলমান প্রক্রিয়া। মামলা দায়ের করার পর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া যেতে পারে।
আয়কর রেকর্ডপত্রে জালিয়াতি
জেসমিন প্রধানের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নম্বরে জন্ম তারিখ আলাদা। পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, তার জন্ম তারিখ ১৯৯৫ সালের ২০ আগস্ট আর জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ১৯৯৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। যা দিয়ে তিনি পৃথক দুটি কর সার্কেলে দুটি পৃথক টিআইএন খোলেন। সেগুলো হলো– টিআইএন নম্বর ২৯৫৯৯৯৭২৮১৮৩, কর অঞ্চল-০৮ (ঢাকা), কর সার্কেল-১৬৫। যেখানে জন্ম তারিখ ২০ আগস্ট, ১৯৯৫। অন্যটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৯৭ সালের জন্ম তারিখ। যার টিআইএন নম্বর ৮৭১৭৭১২২৭৫০১, কর অঞ্চল-১৩ (ঢাকা), কর সার্কেল-২৮৩। এখানে টিআইএন নিলেও আয়কর রিটার্ন দাখিল করা হয়নি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেসমিন প্রধান ২০২১ সালের শেষের দিকের কোনো এক সময় কর সার্কেল-১৬৫, কর অঞ্চল-০৮ এর অফিস কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষের রিটার্ন একই দিনে তড়িঘড়ি করে দাখিল করেন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কর্মচারীদের সহায়তায় কর সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়েছে।
আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে হঠাৎ ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষের প্রায় ২২ লাখ টাকা কর দিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধান নামে তড়িঘড়ি রিটার্ন দাখিল করা হয়। আয়কর নথিপত্র ঘষামাজা করা, পুরোনো চেক ভুলবশত জমা না হওয়ার নাটক এবং মূল রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে সরকারি কোষাগারে রাজস্ব জমাও দেওয়া হয়। এরপরও চাপা থাকেনি জালিয়াতি
২০১৬-১৭ করবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন রেজিস্টারে ঘষামাজা করে বিভিন্ন কলামে মোট আয়, মোট সম্পদ, নিট সম্পদ, পারিবারিক ব্যয় ইত্যাদি পরিবর্তন করা হয়েছে। যার মধ্যে ২০১৬-১৭ করবর্ষে আয়কর রিটার্ন রেজিস্টারে পারিবারিক ব্যয় ও আয়কর রিটার্নে পারিবারিক ব্যয়ে মিল পাওয়া যায়নি। মিল পাওয়া যায়নি ২০২০-২১ করবর্ষে দাখিল করা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে রিটার্ন রেজিস্টারে প্রদর্শিত আয়, মোট সম্পদ ও নিট সম্পদেরও। ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের রেজিস্টারে কোনো দায় উল্লেখ না থাকলেও আয়কর রিটার্নে দায় উল্লেখ করা রয়েছে। ছিল মোট সম্পদ ও নিট সম্পদে বড় তারতম্য। শুধু তাই নয়, জেসমিন প্রধান যে কর সার্কেলের কর্মচারীদের যোগসাজশে ২০১৬-১৭ করবর্ষ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষের রিটার্ন একই দিনে দাখিল করে সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমার্জন করেছেন, তার প্রমাণও মিলেছে।
হাতের লেখায় ভিন্নতা
২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন রেজিস্টারে ঘষামাজা করে বিভিন্ন কলামে মোট আয়, মোট সম্পদ, নিট সম্পদ, পারিবারিক ব্যয় ইত্যাদি পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে হাতের লেখার সঙ্গে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ মূল হাতের লেখার কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
রিটার্ন রেজিস্টারসহ অন্য রেকর্ডপত্রে টেম্পারিং
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেসমিন প্রধান পাঁচ করবর্ষের রিটার্ন একই দিনে দাখিল করে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমার্জন করেছেন। রিটার্ন রেজিস্টার রেকর্ড থেকে দেখা যায়, করদাতার বিভিন্ন করবর্ষে মোট আয়কর, মোট সম্পদ ও নিট সম্পদের কলাম ঘষামাজা করা হয়েছে।
যেমন- করদাতা জেসমিন প্রধান ২০১৬-১৭ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে কর অঞ্চল-৮ এর ১৬৫ সার্কেলে রিটার্ন দাখিল করেছিলেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মোট আয়ের কলামে ঘষামাজা করে লেখা হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৭৪ ধারার কর কলামে ঘষামাজা করে লেখা হয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার টাকা, বিনিয়োগ কলামে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, হাতে নগদ ও ব্যাংকের স্থিতি ঘষামাজা করে চার কোটি ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা, নিট সম্পদের কলামে ৪৮ কোটি ২১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা লেখা হয়েছে। আর নিট সম্পদের জায়গায় লেখা হয়েছে চার কোটি ৮২ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। অন্যদিকে, রিটার্ন রেজিস্টারে পারিবারিক ব্যয় কলামে এক লাখ ২০ হাজার টাকা লেখা হয়েছে। কিন্তু ওই বছরের করবর্ষের আয়কর রিটার্নে করদাতার পারিবারিক ব্যয় খাতে লেখা রয়েছে নয় লাখ ১৫ হাজার ৭৯১ টাকা। একইভাবে ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ করবর্ষের আয়কর রিটার্নে ঘষামাজা, দাখিল করা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে রিটার্ন রেজিস্টারে প্রদর্শিত আয়ে অমিল কিংবা নিট সম্পদের কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
চালান, চেক ও পে-অর্ডারে অর্থ জমায় অনিয়ম
২০১৬-১৭ করবর্ষের ৩০ নভেম্বরের চালানের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষের ২৯ নভেম্বরে পাঁচ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ করবর্ষের ২ ডিসেম্বরের চেকের মাধ্যমে ১৫ হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধিত হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইস্যুকৃত চেকের এক লাখ ৪৭ হাজার টাকা, ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বরের তিন লাখ ৭৯ হাজার ৬৯ টাকার চেক, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর ইস্যু করা চেকের ছয় লাখ ৭৩ হাজার ২৬২ টাকা এবং ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারির নয় লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকার চেক কী কারণে জমা হয়নি, তার যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে, চারটি চেকের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না হওয়ার ব্যাখ্যায় কর্মকর্তা ও করদাতার আইনজীবী ‘ভুলবশত জমা না হওয়ার’ কথা বলছেন, যা পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে মনে করছে দুদক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করদাতা এনআরবিসি ব্যাংকের হিসাব থেকে ২০১৬ সালের ১২ জুলাই ১১ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। ওই টাকা তোলার পর ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ওই চেক বইয়ের পরবর্তী সিরিয়ালের অন্য কোনো চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করেননি। এ ছাড়া করদাতার ইস্টার্ন ব্যাংকের আরেকটি হিসাব (হিসাব নম্বর ১০৪১৪৩০২২৮২৫৮) বিবরণী অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ করবর্ষে চেকের মাধ্যমে প্রদেয় কর ছিল ছয় লাখ ৭৩ হাজার ২৬২ টাকা। কিন্তু রিটার্ন দাখিলে ২ ডিসেম্বরের ব্যাংক হিসাবে মোট স্থিতি ছিল দুই হাজার ৮১৭ টাকা। অনুরূপভাবে, ২০১৯-২০ করবর্ষে প্রদেয় আয়কর ছিল নয় লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকা কিন্তু ওই সময় হিসাব বিবরণীতে মোট স্থিতি ছিল দুই হাজার ৫৮৭ টাকা। অর্থাৎ করদাতার ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলেও দুই করবর্ষে মোট ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৫ টাকার চেক প্রদান করেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
পরবর্তীতে করদাতার পাঁচ করবর্ষের আয়কর তিনটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২০২১ সালে পরিশোধ করা হয়। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের চারটি চেকের মাধ্যমে এক লাখ ৪৭ হাজার টাকা, তিন লাখ ৭৯ হাজার ৬৯ টাকা, ছয় লাখ ৭৩ হাজার ২৬২ টাকা এবং নয় লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকা ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের গুলশান শাখার পে-অর্ডারের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়।
অডিট প্রতিবেদনে জালিয়াতি
করদাতার ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে দাখিল করা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা অডিট প্রতিবেদনটি ২০২০ সালের। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ করবর্ষে দাখিল করা অডিট প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে ২০২০ সালে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত মোট পাঁচ অর্থবছরের অডিট প্রতিবেদন ২৩৮৭, ২৩৮৮, ২৩৮৯, ২৩৯০ ও ২৩৯১ পর্যন্ত ক্রমিকে সম্পন্ন করে রেফারেন্স লেখার সময় তারিখের অংশে প্রতিটি রিপোর্টে যথাক্রমে ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর লেখা হলেও পাঁচটি অডিট রিপোর্টই মূলত একই তারিখে দেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
আদেশপত্রে জালিয়াতি
অনুসন্ধানে দেখা যায়, করদাতা জেসমিন প্রধানের ২০১৬-১৭ করবর্ষে করদাতার রিটার্ন গ্রহণের তারিখ ছিল ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর এবং ২০১৭-১৮ করবর্ষের রিটার্ন দাখিলের তারিখ ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর। ২০১৬-১৭ করবর্ষ ও ২০১৭-১৮ করবর্ষে ওই সার্কেলে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান দায়িত্ব পালন করলেও আদেশপত্রে উপ-কর কমিশনারের স্বাক্ষরের স্থলে দুই রকম স্বাক্ষর রয়েছে। এনবিআরের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনে ২০১৬-১৭ করবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন এবং আদেশপত্রে যে পরিবর্তন করা হয়েছে তা ২০১৮-১৯ করবর্ষের পরে কোনো এক সময় করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত প্রতিটি আদেশপত্র ওই সার্কেলের তৎকালীন উচ্চমান সহকারী (পিআরএল) হিরেশ লাল বর্মণ প্রস্তুত করেছেন। করদাতাকে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের আয়কর সনদ ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রদান করা হলেও আদেশপত্রে সনদ প্রদানে ২০২০-২১ করবর্ষে আয়কর মামলা নিষ্পত্তির তারিখ ছিল ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন, আদেশপত্র, রিটার্ন রেজিস্টার, স্টক রেজিস্টার, মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টারগুলো পর্যবেক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রত্যেক করবর্ষে করদাতা কর্তৃক আয়কর রিটার্নে নতুন করে মোট আয় বৃদ্ধি, ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষে নতুন করে দায় প্রদর্শন এবং প্রথমবার ২০১৬-১৭ করবর্ষে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিলের সুযোগ নিয়ে ৮২ বিবি (১১) ধারায় প্রারম্ভিক পুঁজির সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেক করবর্ষে ফরেন রেমিট্যান্স প্রদর্শন করে অপ্রদর্শিত সম্পদ আয়কর রিটার্নে সংযোজন করা হয়েছে
২০২০ সালের নভেম্বরে পাপুলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্তকালে জেসমিন প্রধানের আয়কর নথি যাচাই-বাছাইকালে ট্যাক্স ফাইল টেম্পারিং করার আলামত পেলে তৎকালীন অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বিষয়টি নিয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপরই এনবিআর থেকে বিষয়টি যাচাই করতে তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মো. শাহাদৎ হোসেন শিকদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়। ওই কমিটি ২০২২ সালের ২৮ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই টিমের পর্যবেক্ষণেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়কর রিটার্ন রেজিস্টারগুলোতে ঘষামাজা করে বিভিন্ন কলামে পরিবর্তন, মূল রেকর্ড বিনষ্টকরণ, স্বাক্ষর জালিয়াতি করে মূল আয়কর রিটার্ন ও আদেশপত্রগুলো সরিয়ে পরিবর্তিত আয়কর রিটার্ন ও আদেশপত্রগুলো করদাতার আয়কর নথিতে রাখা হয়েছে।
২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন, আদেশপত্র, রিটার্ন রেজিস্টার, স্টক রেজিস্টার, মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টারগুলো পর্যবেক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে প্রত্যেক করবর্ষে করদাতা কর্তৃক আয়কর রিটার্নে নতুন করে মোট আয় বৃদ্ধি, ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষে নতুন করে দায় প্রদর্শন এবং প্রথমবার ২০১৬-১৭ করবর্ষে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিলের সুযোগ নিয়ে ৮২ বিবি (১১) ধারায় প্রারম্ভিক পুঁজির সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেক করবর্ষে ফরেন রেমিট্যান্স প্রদর্শন করে অপ্রদর্শিত সম্পদ আয়কর রিটার্নে সংযোজন করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেসমিন প্রধান ২০২১ সালের শেষের দিকের কোনো এক সময় কর সার্কেল-১৬৫, কর অঞ্চল-০৮ এর অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন একই দিনে তড়িঘড়ি করে দাখিল করেন। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কর সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়েছে। যার প্রমাণ মিলেছে দুদকের জব্দ করা নথিপত্রেও।
জেসমিন প্রধানের ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত অর্থাৎ মোট পাঁচ করবর্ষের আয়কর রিটার্নগুলো রিটার্ন রেজিস্টারে যথাক্রমে ৮৬৮, ৬৫৩, ৭৮০, ১১০১ ও ৫৬নং ক্রমিকে এন্ট্রি হয়। রিটার্ন রেজিস্টারের রেকর্ড থেকে দেখা যায়– ১. মোট আয়ের কলামে ঘষামাজা, ২. ৭৪ ধারার কর কলামে ঘষামাজা, ৩. ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ কলামে ঘষামাজা, ৪. হাতে নগদ ও ব্যাংক স্থিতি কলামে ঘষামাজা, ৫. রিটার্ন রেজিস্টারে নিট সম্পদ কলামে ভিন্ন ভিন্ন হাতের লেখায় বিভিন্ন সংখ্যা বসানো, ৬. রিটার্ন রেজিস্টারে পারিবারিক ব্যয়ের যে তথ্য লেখা রয়েছে তা আয়কর রিটার্নে ভিন্ন পাওয়া গেছে।
আর আয়কর নির্ধারণী আদেশপত্রে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর রিটার্ন দাখিলের তারিখেই করদাতাকে ওই মাসের ৩১ তারিখে শুনানির জন্য ৭৯ ও ৮৩ (১) ধারায় নোটিশ জারি করা হয়েছিল। সার্কেল কর্মকর্তা খন্দকার মো. হাসানুল ইসলামের কাছে করদাতার পক্ষে আয়কর আইনজীবী মো. আদনান শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানি শেষে ২০২০-২১ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নথিপত্র অনুসারে, ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর সাধারণ ধারায় রিটার্ন দাখিল করলেও রিটার্নের সঙ্গে ৭৪ ধারায় প্রদেয় আয়কর ছিল নয় লাখ ৬৮ হাজার ১২৫ টাকা। যদিও ওই দিন কর দাখিল হয়নি, পরবর্তীতে ১৪ ডিসেম্বর পে-অর্ডারে ব্যাংক এশিয়া লিমিটেডের গুলশান শাখার মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। আয়কর নথি থেকে খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম অনুস্বাক্ষরিত ও ক্যানসেল লেখা চারটি চেক জব্দ করা হয়েছে, যার বৈধতা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেছে।
দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, জেসমিন প্রধানের ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত অর্থাৎ মোট পাঁচ করবর্ষের আয়কর রিটার্নগুলো রিটার্ন রেজিস্টারে যথাক্রমে ৮৬৮, ৬৫৩, ৭৮০, ১১০১ ও ৫৬নং ক্রমিকে এন্ট্রি হয়। রিটার্ন রেজিস্টারের রেকর্ড থেকে দেখা যায়– ১. মোট আয়ের কলামে ঘষামাজা, ২. ৭৪ ধারার কর কলামে ঘষামাজা, ৩. ব্যবসায় মূলধন বিনিয়োগ কলামে ঘষামাজা, ৪. হাতে নগদ ও ব্যাংক স্থিতি কলামে ঘষামাজা, ৫. রিটার্ন রেজিস্টারে নিট সম্পদ কলামে ভিন্ন ভিন্ন হাতের লেখায় বিভিন্ন সংখ্যা বসানো, ৬. রিটার্ন রেজিস্টারে পারিবারিক ব্যয়ের যে তথ্য লেখা রয়েছে তা আয়কর রিটার্নে ভিন্ন পাওয়া গেছে
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ করবর্ষের ৩০ নভেম্বরের চালানের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষের ২৯ নভেম্বরে পাঁচ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ করবর্ষের ২ ডিসেম্বরের চেকের মাধ্যমে ১৫ হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধিত হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইস্যু করা চেকের এক লাখ ৪৭ হাজার টাকা, ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বরের চেকে তিন লাখ ৭৯ হাজার ৬৯ টাকা, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর ইস্যু করা চেকের ছয় লাখ ৭৩ হাজার ২৬২ টাকা এবং ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারির চেকে নয় লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকা জমা হয়নি। ওই চারটি চেক সরকারি কোষাগারে জমা না হওয়ার কারণ হিসেবে সেগুলো ‘পরবর্তীতে দাখিল করা’ বলে দুদক মনে করছে।
করদাতার স্টক রেজিস্টার ও মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, করদাতার ২০১৬-১৭ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ২০১৯-২০ করবর্ষের ৮২ বিবি ধারায় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা মোট আয় হিসেবে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে। কিন্তু আয়কর রিটার্নে ২০১৬-১৭ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় আয় ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৭-১৮ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় আয় ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ করবর্ষে ওই একই আয় ৩৬ লাখ ৪৫ হাজার এবং ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ করদাতার আয়কর রিটার্নের সঙ্গে স্টক রেজিস্টার ও মাসিক কর নির্ধারণী রেজিস্টারের কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় জেসমিন প্রধান কর অঞ্চল-৮ এর কর্মচারীদের যোগসাজশে ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত রিটার্ন একই দিনে দাখিল করে সার্কেলের যাবতীয় রেজিস্টারে ঘষামাজা করে টাকার অঙ্ক পরিবর্তন-পরিমার্জন করেছেন। ওই সার্কেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সহায়তায় রিটার্ন রেজিস্টার ঘষামাজা করে মোট আয়, মোট সম্পদ, নিট সম্পদ, পারিবারিক ব্যয় ইত্যাদি পরিবর্তন করার সঙ্গে উপ-কর কমিশনার খন্দকার মো. হাসানুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী হিরেশ লাল বর্মণ সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে।
প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল এবং তার স্ত্রী এমপি সেলিনা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর মামলা করে দুদক। আসামিদের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ এবং ১৪৮ কোটি টাকার লন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয় মামলায়।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। পরে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করিয়ে আনেন। অর্থ ও মানবপাচার এবং ঘুষ প্রদানের অভিযোগে ২০২০ সালের জুন মাসে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন পাপুল। ওই মামলার বিচার শেষে ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেয় কুয়েতের একটি আদালত। কুয়েতের রায়ের নথি হাতে পাওয়ার পর ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাপুলের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে জাতীয় সংসদ।
Leave a Reply