গর্ভসঞ্চারের পরে দুই-এক মাসের মধ্যেই আপাদমস্তক বদলে যেতে থাকে হবু মায়ের শরীর-মন। সময়ের সঙ্গে পেট তো বড় হয়ই, তার পাশাপাশি কেউ সুন্দর হয়ে ওঠেন, ত্বকের চাকচিক্য বাড়ে, চুলের গোছ বাড়ে, বাড়ে হাসিখুশিভাব। কারোর ক্ষেত্রে হয় ঠিক উল্টোটা। রুক্ষ্ম চেহারায় পড়ে ক্লান্তির কালিমা, মেজাজ খিটখিটে হতে থাকে, কথায় কথায় রাগারাগি বা কান্নাকাটি শুরু করেন তারা।
বিজ্ঞানের মতে, এ সবই হয় হরমোনের কারণে। গর্ভসঞ্চারের সূচনা থেকেই হাজারো হরমোনের উথাল-পাথাল শুরু হয়ে যায় ভাবী মায়ের শরীরে। ফলে প্রথম তিন মাস, যাকে বলে ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার। ভ্রূণের মাপ যত ছোটই হোক না কেন হাজারো পরিবর্তন আসতে শুরু করে মায়ের শরীরে-মনে। যদিও সবার ক্ষেত্রে সব কিছু একভাবে ঘটে না, তাও প্রথম তিনমাসে যা যা পরিবর্তন হয়, তা হলো—
>> গ্রাস করে একরাশ ক্লান্তি।
>>ঘুমের অসুবিধে হয় অনেক সময়।
>>কারো কারো মাথাব্যথা হয়।
>>অকারণ মনখারাপ হয় অনেকের, কারো আবার হয় ঠিক উল্টো।
>>ব্রেস্ট ভারী হতে শুরু করে। একটু ছুঁলেই যেন ব্যথা লাগে।
>>গা-বমি করে। খাবার দেখলে বা গন্ধ নাকে এলেও বমি পায়। কারো কারো বমিও হতে থাকে। কিছু ভাগ্যবানের অবশ্য এসব কিছু হয় না।
>> স্বাদ আমূল পাল্টে যায় মুখের। কারো মিষ্টি ভালোলাগে, কারো ঝাল ও নোনতা, কারো টক, যা আগে হয়ত অন্যরকম ছিল। আগে যে সমস্ত খাবার পছন্দের ছিল, সে সবে বিতৃষ্ণা জাগে কখনো আর অপছন্দের খাবারে হয়ত জাগে আগ্রহ। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের অখাদ্যে আসক্তি জাগে। যেমন, চক, মাটি, ছাই ইত্যাদি, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে পাইকা।
>> বেশি না খাওয়া সত্তেও বার বার টয়লেট ছুটতে হয়।
>>কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার
এই সময় থেকে ভ্রূণের মাপ বাড়তে থাকে। বাড়ে জরায়ুর মাপ। সে আস্তে আস্তে বুকের দিকে উঠতে থাকে। এর ফলে যে যে উপসর্গ দেখা দেয়, তা হল—
>>পাকস্থলীর উপর চাপ বাড়ে। তার হাত ধরে অম্বলের উপসর্গ বাড়ে অনেকের, যাকে বলে রিফ্লাক্স। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুধা পায় না বা গা বমিভাব কমে যায় এ সময়।
>>আস্তে আস্তে বাচ্চার নড়াচড়া বোঝা যেতে থাকে। প্রথম বাচ্চার ক্ষেত্রে নড়াচড়া বোঝা যায় ১৮-২২ সপ্তাহে। দ্বিতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রে আরেকটু আগে, মোটামুটি ১৮-১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বোঝা যায়। প্রথম দিকে পেট একটু গুড় গুড় করে, গ্যাস হলে যেমন হয়, অনেকটা সে রকম। এর কিছুদিন পর থেকে লাথি টের পাওয়া যায়। আচমকা পেটের কোনো অংশ ফুলে উঠলে বোঝা যায় তা বাচ্চার হাতের মুঠো বা পায়ের পাতা।
>>২৩ সপ্তাহের পর বাচ্চার ঘুমোনো ও জেগে থাকার ছন্দের সঙ্গে মায়ের ছন্দের মিল থাকে না। ফলে কাজকর্ম সেরে মা যখন ঘুমোতে গেলেন, তখনই হয়তো শুরু হল তার লাথি-ঘুসির পর্ব৷ ফল বুঝতেই পারছেন। দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারের মাঝামাঝি সময় থেকে স্পষ্ট হতে থাকে বেবি বাম্প।
তৃতীয় ট্রাইমেস্টার
>>এই সময় বাচ্চা বড় হতে থাকে। ফলে পাকস্থলী, অন্ত্রকে ফুসফুসের দিকে ঠেলে সে বুকের দিকে উঠতে থাকে৷ ফলে—
>>অম্বল তথা রিফ্লাক্সের প্রকোপ বাড়ে৷ বদহজমও বাড়ে অনেক সময়।
>> ফুসফুসের ওপর চাপ বাড়ায় হালকা শ্বাসকষ্ট হয় থেকে থেকে।
>> ব্লাডারের ওপর চাপ বাড়ায় বার বার বাথরুমে ছুটতে হয়৷ শরীর বেশি ভারী হয়ে গেলে হাচি-কাশির সময় ইউরিন লিক করে অনেক সময়৷
শরীর ভারী হওয়ায় চলাফেরায় কষ্ট হয়। ব্যালেন্স রাখা একটু কঠিন হয় অনেক সময়।
>> ভারী পেট ও ব্যালেন্সের অভাবের ফলে কোমর ব্যথা হয় অনেক সময়৷ পায়ের শিরাতেও টান পড়তে পারে।
>>ঘুমের দফারফা হয় অনেকেরই। শরীর ভারী হওয়ায় কীভাবে শুলে যে আরাম হবে তা বুঝতে বুঝতেই রাত কাবার হয়ে যায়।
>>প্রসবের পর উপসর্গ সব গায়েব। তবে বাড়তি জরায়ুকে তার নিজের আকার ও মাপে ফিরতে কিছুটা সময় লাগে। এটুকু সময় দিলে আর কোনো সমস্যা নেই। শুধুই আনন্দ। অবশ্য সামান্য কিছু ক্ষেত্রে কখনো আবার হরমোনের কারণেই দুঃখ-অবসাদ বাড়ে৷ তবে কাছের মানুষের সহযোগিতা পেলে ও প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিলে সে সমস্যা কাটতে সময় লাগে না।
Leave a Reply