আঁকাবাঁকা বয়ে গেছে তুলসীগঙ্গা নদী। নদীর ধার ঘেঁষে ফাঁকা স্থান আর বাঁধ। ফাঁকা স্থান আর বাঁধের অনেক জায়গায় বড় বস্তা কিংবা জাল বিছিয়ে শুকানো হচ্ছে ঝুরি ঝুরি পাতলা করা আলু। এসব শুকানো আলু ভেজে তৈরি হচ্ছে চিপস। এ থেকেই অর্থ আয় করছেন অনেকে।
আলু থেকে চিপস প্রস্তুতের এমন কার্যক্রমের দেখা মিলবে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌরসভার শ্রীকৃষ্টপুর এলাকায়। আড়াই মাস ধরে চলা এই কাজের জন্য ওই এলাকার প্রায় ৪০০ পরিবারের ৮৫ শতাংশই এই পেশার সঙ্গে জড়িত। শ্রীকৃষ্টপুর ছাড়াও পাশের কেশবপুর ও ভদ্রকালী গ্রামের কিছু মানুষও এসব চিপস বিক্রি করে উপার্জন করছে। আড়াই মাসে প্রায় দুই কোটি টাকার চিপস উৎপাদন হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
গ্রাম ঘুরতেই চোখে পড়বে, কেউ আলু সেদ্ধ করছেন, আবার কেউ সেদ্ধ আলু পাতলাভাবে গোলাকার করে কাটছেন। আবার কেউ কেউ গোলাকার আলু রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সী মানুষ চিপস প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। আলুর চিপস তৈরি ও বিক্রি করে যা আয় হয় তা চলে দিয়ে তাদের সংসার।
চিপস প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিতরা জানান, ক্যাডিনাল জাতের আলু চিপস তৈরির কাজে অনেক ভালো, আর ওই হাতের আলু ব্যবহার করা হয়। অন্য জাতের আলু দিয়ে চিপস তৈরি হলেও তেমন স্বাদ মেলে না। বাজার থেকে প্রতি মণ ক্যাডিনাল আলু ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে কেনা হয়। সেই আলু সেদ্ধ করার পর গোলাকার করে কেটে রোদে শুকিয়ে ভেজে চিপস তৈরি করা হয়। এক মণ আলুর আট থেকে সাড়ে আট কেজি চিপস হয়। প্রতি মণ চিপস চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
এ কাজের সঙ্গে জড়িত রুবি খাতুন বলেন, যার যেমন সার্মথ্য তিনি সে অনুয়ায়ী আলু কিনে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর দেড় মণ, দুই মণ নিয়ে পানিতে ধুয়ে সেদ্ধ করতে হয়। সেগুলো আবার একটু ঠান্ডা হলে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বটি দিয়ে কাটতে হয়। ভোরের দিকে আবার নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে একটি একটি করে শুকাতে দিতে হয়। সেগুলো আবার বিকেলে তুলতে হয়। রোদ ভালো হলে এক মণ আলুর চিপস শুকাতে দুই দিন সময় লাগে। শুকানোর পর সেসব চিপস বিক্রির উপযোগী হয়। এ কাজে আমাদের অনেক কষ্ট।
৩৫০ মণ আলু আলু কিনে চিপস তৈরি করছেন জান্নাতুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আলুর চিপসের ব্যবসা করি। পরিবার নিয়ে এই কাজ করি। সব সময় এই কাজে লেগেই থাকতে হয়। দুই মাস আলুর চিপসের চাহিদা ব্যাপক থাকে। তারপর বৃষ্টি নামলে সেভাবে শুকানো যায় না।
নিজ পুঁজি থেকে বছরে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার মণ আলু কেনেন মোহাম্মদ আলী বাবু। তিনি বলেন, এসব আলু কিনে আমি গ্রামের মানুষদের বাড়িতে দিয়ে চিপস তৈরি করে নিই। এর বিনিময়ে তাদের টাকা দেওয়া হয়। অনলাইনে বা মোবাইলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকার মহাজনরা জানালে আমরা সেখানে কুরিয়ার করে চিপস পৌঁছে দেই।
তিনি আরও বলেন, এসব কাজ করে সামান্য কিছু লাভ থাকে। এ দিয়ে আমাদের দিন চলে যায়। তবে সরকারিভাবে ঋণ সহায়তা পেলে আমরা এই কাজ আরও বড় পরিসরে করতে পারবো। এতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
আলুর চিপস ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি মৌসুমে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত আলুর চিপস তৈরির কাজ করা হয়। প্রতি মৌসুমে ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার মণ আলু কাটা হয়। এবারও ২০ হাজার মণের বেশি আলু কাটা হবে। বর্তমানে প্রকারভেদে ৪ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মণ চিপস বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ৫ মণ আলু থেকে এক মণ চিপস তৈরি হয়। এক মণ চিপস তৈরি করতে ৩ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। সেই হিসেবে প্রতি বছর দুই কোটি টাকার চিপস বিক্রি হয়ে থাকে। এতে খরচ বাদে কয়েক লাখ টাকা লাভ থাকে ব্যবসায়ীদের।
আক্কেলপুর পৌরসভার মেয়র শহীদুল আলম চৌধুরী বলেন, এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অতি দরিদ্র। সরকারি সহযোগিতা পেলে আরও ভালো কিছু হতো। তাদেরকে সহায়তা করার মতো পৌরসভায় কোনো প্রজেক্ট নেই। তবে কেউ এসে সহযোগিতা চাইলে সেটি করা হয়।
আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের উদ্যোক্তারা অনেকদিন ধরে আলু থেকে চিপস তৈরির কাজ করে আসছেন। এখান থেকে নতুনভাবে আয় করা সুযোগ হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হচ্ছে। আলু শুধু সবজি হিসেবে না খেয়ে প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে ব্যবহার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমরা এই শিল্পকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো। তাদেরকে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রদান ও এই আলুর চিপসকে আরও স্বাস্থ্যকর উপায়ে প্রস্তুত করা যায় কিনা সে বিষয়টিতে আমরা নজর দেব।
Leave a Reply