এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এবার পরীক্ষার জন্য নবম শ্রেণিতে নিবন্ধন করেছিলেন ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৩ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে দশম শ্রেণিতে গিয়ে ফরম পূরণ করেন ১৭ লাখ ১০ হাজার ২৯৬ জন। অর্থাৎ, বছরের ব্যবধানে লেখাপড়া ছেড়েছেন ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ শিক্ষার্থী। অনেক শিক্ষাবিদ ও অভিভাবক মনে করেন, ঝরে পড়ার পেছনে কোভিড মহামারীর প্রভাব রয়েছে।
এখন যারা মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় বসছেন, মহামারীর দুই বছর (২০২০ ও ২০২১) তারা ছিলেন যথাক্রমে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওই দুই বছরের শিখন ঘাটতি পূরণ না হওয়ায় প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষাতেও আটকে যান অনেক শিক্ষার্থী। দরিদ্রতাও একটা কারণ।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, এবারের এসএসসি, দাখিল, এসএসসি-ভোকেশনাল ও দাখিল-ভোকেশনাল পরীক্ষায় ২৯ হাজার ৭৩৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ পরীক্ষার্থী ৩ হাজার ৭০০ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবে। এর মধ্যে আছে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী ৩ লাখ ১১ হাজার ৫৩৩ জন এবং ২ হাজার ৩৬৩ জন দেবেন ফল উন্নয়নের (ইনপ্রুভমেন্ট) পরীক্ষা।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে রাজধানীর সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক একেএম ওবাইদুল্লাহ গতকাল বলেন, ‘কোভিড মহামারীর প্রভাব এখনো শিক্ষা খাতে বিরাজমান।’ এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘এ বছর যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন, এরা ২০২০ সালে সপ্তম শ্রেণি আর ২০২১ সালে পড়তেন অষ্টম শ্রেণিতে। এই দুই বছরের যে শিখন ঘাটতি, তা পূরণ হয়নি নবম শ্রেণিতে। ফলে ফরমপূরণের আগে স্কুলের প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর ফল ভালো হয়নি। আর অনেক স্কুল ভালো রেজাল্ট দেখানোর জন্য এ ধরনের শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়নি।’
এর বাইরে আর কোনো কারণ আছে কিনা জানতে চাইলে ওবাইদুল্লাহ বলেন, আমাদের শহর ও গ্রামে শিক্ষাব্যয়ে বৈষম্য আছে। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি সব সময় শিক্ষায় প্রভাব ফেলে। গ্রামে কিংবা শহরে দরিদ্রতা শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বড় কারণ।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গতকাল বলেন, ‘প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় এটি প্রতিবার হয়। তবে করোনার প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। স্কুলগুলোয় ভর্তিও কমে যাচ্ছে। এ কারণেও মাধ্যমিকে এসে পরীক্ষার্থী কমছে।’
২০২০ সালে সেগুনবাগিচা হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া এক শিক্ষার্থী জানান, কোভিড মহামারীর সময় তার বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় রাজধানী থেকে তারা গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পরে আবার ঢাকায় ফেরা হলেও তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি।
মগবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক জানান, তিনি মহামারীর সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বেতন অনিয়মিত হওয়ায় পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দেন। নিজে রাজধানীতে ফুটপাতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা উপকরণ বিক্রি করেন। মেয়ের লেখাপড়া চালানোর সক্ষমতা না থাকায় গেল বছর বিয়ে দিয়ে দেন। আর ছেলের এ বছর এসএসসি দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দেবে না, সে এখন মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখছে।
ঝরে যাওয়া রোধে সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ে অনেকবার সতর্ক করে বলা হয়েছিল যে, এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে; এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক সময় লাগবে। এখনো আমরা দেখছি শিক্ষায় এর প্রভাব কতটা রয়ে গেছে! আমাদের এসডিজি অর্জনের জন্য ঝরে পড়া বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে এই হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রাথমিকে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের ঝরে পড়ার হার বেশি। তবে মাধ্যমিকে গিয়ে ভিন্নচিত্র। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি।
Leave a Reply