প্রতিবছর দুই ঈদ ঘিরে ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য যে যুদ্ধ হয় কমলাপুর স্টেশনে, এবার আর সে দৃশ্য দেখা যাবে না। যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে এবার ঈদে ট্রেনের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এবার ঈদে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোতে প্রতিদিন মোট আসন সংখ্যা হবে ২৫ হাজার ৭৭৮টি। ঢাকা ও জয়দেবপুর থেকে তিনটি ঈদ স্পেশাল ট্রেনে আরও তিন হাজার আসন থাকবে।
সব মিলিয়ে প্রতিদিনের এই ২৮ হাজার ৭৭৮টি আসনের টিকিট পুরোটাই বিক্রি হবে অনলাইনে।
স্টেশনে টিকিট কাটার বিড়ম্বনা থাকবে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, তারপরও একটা বিষয় সবাইকে ভাবাচ্ছে- টিকিট পাবে কতজন, পাবে না আরও কতজন?
কারা হবেন টিকিটিজয়ী ২৯ হাজার ভাগ্যবান? সময় এলেই পাওয়া যাবে সে উত্তর। একই সঙ্গে ২৯ হাজার টিকিট শেষ হতে কত সময় লাগবে সেটা নিয়েও জোর আলোচনা চলছে।
টিকিটপ্রত্যাশীরা মনে করছেন, এবার ঈদে ট্রেনের টিকিট হবে লটারির মতো। বলা যাবে না কার ভাগ্য খুলবে। হয়তো এবার স্টেশনে স্টেশনে মানুষের কষ্ট হবে না। কিন্তু টিকিট কারা পেল, এটাও জানা যাবে না। টিকিট পাওয়া থেকে একটি পক্ষ যে বঞ্চিত হবে সেটি মানতেই হবে।
টিকিটপ্রত্যাশীরা মনে করছেন, অনলাইনে একটি ট্রেনের আসন সিলেক্ট করা থেকে শুরু করে পেমেন্ট করা পর্যন্ত একজন টিকিটপ্রত্যাশীকে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়। কেউ এই প্রক্রিয়া ১/২ মিনিটে শেষ করেন, আবার কেউ ৫/৭ মিনিট সময় নেন। সেই হিসেবে এবার ঈদে ট্রেনের অগ্রীম টিকিট প্রথম ৩ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে।
আর রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এত অল্পসংখ্যক আসন শেষ হতে মিনিটও পার হবে না। হাজারে হয়তো ৩-৫ জন মানুষ টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রেনের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পায় ‘সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি’ কর্তৃপক্ষ। এরপর গত দুই ঈদে সার্ভার জটিলতা, সাইটে টিকিটের জন্য ইউজারের কিইউতে থাকা, টিকিট ভাড়ার অসামঞ্জস্যতাসহ নানা সমস্যা দেখা গিয়েছিল। তবে, এসব জটিলতা কাটিয়ে এবার মিনিটে ৫ লাখ টিকিট বিক্রির সক্ষমতার কথা জানিয়েছে ‘সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভি’ কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে রেলমন্ত্রীও জানিয়েছেন, ঈদের সময় কমলাপুরে যে পরিবেশ তৈরি হয়— এটা রেলের জন্য খুবই বিব্রতকর হয়। ঈদের সময় আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যায়। তাই অনলাইনে শতভাগ টিকিট দেওয়া হবে।
এবারও ঈদের টিকিটপ্রত্যাশী আসিফ ইবনে মোমিন বলেন, প্রতিবারই টিকিটের জন্য যুদ্ধ করতে হয়। টিকিট কাউন্টারের সামনে সেই যুদ্ধে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলেও ২/৪টি টিকিট পাওয়া যায়। কিন্তু এবার কী হবে জানি না। এবার অলনাইনের যেই যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে কারা জিতবে বলা যায় না। সকাল ৮টায় টিকিট ছাড়বে। সেই সময় টিকিটের জন্য আমার মতো হাজারও মানুষ হিট করবে ওয়েব সাইটে। এটা জাস্ট একটা লটারির মতো। সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের মধ্যে সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাবে। কপাল ভালো থাকলে টিকিট পাবো। না হলে অন্য ব্যবস্থা করে ঈদে বাড়ি যেতে হবে।
আরেক টিকিটপ্রত্যাশী তানজিম মুস্তাকিন অনিক বলেন, আগেরবারের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ওইদিন সকালে এতো মানুষের হিটে সার্ভার ডাউন হতে পারে। অনলাইনে টিকিট কিনতেও ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে মানুষের। শতভাগ অনলাইনের সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ভালো বলতে পারবো না। কিছু টিকিট কাউন্টারে রাখা উচিত ছিল। এখনও দেশে অনেক মানুষ আছে, যারা অনলাইনে টিকিট কিনতে পারবে না। ওই প্রক্রিয়ার জ্ঞান তাদের নেই। তাদের কথা ভেবে অন্তত কিছু টিকিট কাউন্টারে দিতে পারতো রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
অনলাইনে টিকিট কেনার সাইটে একটি টেকনোলজি যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে একসঙ্গে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যকের বেশি মানুষ ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারে না। এই ধরনের সিস্টেম যুক্ত করে আপনারা ওয়েবসাইট সচল রাখতে চাচ্ছেন। এই সচল রাখার প্রক্রিয়টি অন্যায় কি না— এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহজ-সিনেসিস-ভিনসেন জেভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ দেবনাথ বলেন, গতবার আমাদের যে সার্ভার ক্যাপাসিটি ছিল, সেখান থেকে বর্তমানে ২৫০টি সার্ভার ব্যবহার করার প্রক্রিয়া করা হয়েছে। আমাদের সিস্টেম একটা টেকনোলজি আপডেট করা হয়েছে, যাতে ব্রাউজিং আরও ফাস্টার হতে পারে। প্রতি মিনিটে সার্চিং ক্যাপাসিটি বাড়ানো হয়েছে আমাদের সার্ভারে। এর আগে দুটো ঈদে আমাদের প্রতি মিনিটে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টিকিট বিক্রি করার একটা ক্ষমতা ছিল। এবার সেটি বাড়ানো হয়েছে। আমরা ৫ লাখ টিকেট প্রতি মিনিটে বিক্রি করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ সময়ে যখন প্রতিদিন টিকেট বিক্রি হয়, তখন ৮০ থেকে ৯০টি সার্ভার অপারেশনে থাকে। বেশি চাপ হলে সেটি ১৫০টি পর্যন্ত বাড়ানোর সক্ষমতা রেখেছিলাম। এবার ২৫০টি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আমরা আশা করছি ২৫০টি সার্ভার ওই সময়ে খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারবে। আমাদের টোটাল টিকিট ২৮ হাজারের কিছু বেশি। এই টিকিটের পরিমাণ গতবারের মতোই আছে। সুতরাং আমরা মনে করি আমাদের যে সিস্টেম ক্যাপাসিটি আছে, সেটি দিয়ে আমরা এই লোড খুব ভালোভাবে সামলাতে পারবো।
এবার কোন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে না বলে আশা প্রকাশ করে সন্দ্বীপ দেবনাথ বলেন, জটিলতার ক্ষেত্রে যেটা হয়— যে ইউজার অলরেডি সিস্টেমে ঢুকে গেছে এবং একটা সিট বুক করে ট্রানজেকশন কমপ্লিট করার চেষ্টা করছে, এই ইউজার যেন নির্বিঘ্নে ট্রানজেকশন কমপ্লিট করতে পারে। অতিরিক্ত চাপের কারণে ট্রানজেকশন যেন ব্রেক না হয়। সেটা বন্ধ রাখার জন্য মেকানিজমটা করা হয়। এটা এমন না যে, আমরা অন্য ইউজারদের ঢুকতে দিচ্ছি না। আমরা আশা করছি আমাদের এবার যে ক্যাপাসিটি আছে, আমাদের নতুন করে ওই মেকানিজমটায় যাওয়ার দরকার পড়বে না। এর বাইরেও যদি দেখা যায় হঠাৎ করে বেশি লোড চলে আসে, তাহলে আমাদের কারেন্ট ইউজারদের ট্রানজেকশন নির্বিঘ্ন করতে আমরা প্রি-মেকানিজম ইন্ট্রোডিউস করতে পারি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন বলেন, সার্ভার কিন্তু কালোবাজারি চেনে না। এ পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ। ঈদযাত্রার আগেই এটা পৌঁছাতে পারে ২২-২৫ লাখে। দিনে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর ট্রেনের সর্বমোট আসন হবে ২৫ হাজার। এই ২৫ হাজার আসনের জন্য যদি ২৫ লাখ লোক চেষ্টা করে, তাহলে টিকিট পাবেন হাজারে প্রায় ৩ জন। বাকি ৯৯৭ জন টিকিট পাবেন না।
শতভাগ অনলাইনে টিকিট বিক্রি প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, ঈদের সময় কমলাপুরে যে পরিবেশ তৈরি হয়— এটা রেলের জন্য খুবই বিব্রতকর হয়। মানুষ দুই দিন কমলাপুরে থেকেও টিকিট পায় না। সব মানুষ টিকিট পাবে না। ঈদের সময় আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যায়। তাই অনলাইনে শতভাগ টিকেট দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, বাড়িতে বসেই আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন ১৭ তারিখে আপনি যাবেন কি, যাবেন না। সেখানে আপনি বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। কিন্তু আমাদের কোনো অধিকার নেই একজন যাত্রীকে ওই স্টেশনে সারারাত দাঁড় করিয়ে রেখে তারপরে জানানো, টিকেট নেই। আমার মনে হয় আপনারা অনুভব করেন কিভাবে যাত্রীদের এই কষ্ট সহজ করা যায়। আমার সঙ্গে আপনারা একমত হবেন। এটা যে একেবারেই ফাইনাল, তা না। ঈদের বিষয়টা ম্যানেজমেন্ট করার জন্য এবার যদি দেখি কোন বড় ধরনের ভুল ত্রুটি হচ্ছে, সেই বিষয়গুলো আগামী ঈদে যেন আমরা সারাতে পারি। কাজেই আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিলাম সেগুলো জনস্বার্থে এবং যাত্রী সেবা আরও বেশি সহজ ও নিশ্চিত করার জন্যই এই উদ্যোগগুলো।
যারা অনলাইন সুবিধার বাইরে আছে তাদের আপনি বঞ্চিত করছেন কিনা এবং এটি পারেন কিনা— এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, সবাইকে আমি ট্রেনে নিতে পারব? বঞ্চিতের বিষয়টা এখানে প্রযোজ্য না। যে মানুষটা মোবাইল কিনতে পারছে না, তাকে আমি কিভাবে মোবাইল কেনাবো। আমরা ধরে নিচ্ছি আমাদের দেশে বর্তমানে যে জনসংখ্যা, মোবাইল ইউজারের সংখ্যা তার কাছাকাছি। কাজেই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শতভাগ মানুষকে আপনি খুশি করতে পারবেন না। সবাইকে তো আমি নিয়ে যেতে পারবো না। একদিন আমি ২৮ হাজারের মানুষকে আমি নিয়ে যেতে পারবো এবং এই ২৮ হাজার মানুষকে যেন সঠিকভাবে নিয়ে যেতে পারি, এটি আমাকে প্রথম নিশ্চিত করতে হবে।
Leave a Reply