সড়কপথে ঈদযাত্রায় গাড়ির ধীরগতি ও যানজট নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষকে এ ভোগান্তি মেনে নিয়েই নীড়ে ফিরতে হয়। দেশের সড়ক পথগুলোর মধ্যে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ অন্যতম দীর্ঘ ও ব্যস্ততম রুট। এই পথে যাত্রীর চাপ বরাবরই বেশি থাকে। ঈদের সময় ভোগান্তিও বেশি হয় এই রুটে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে বাইপাইল ও চন্দ্রা মোড়ে সবচেয়ে বেশি যানজটের কবলে পড়ে সড়কপথের গাড়িগুলো। বাইপাইল থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়ক পার হতে গাড়িগুলোর কখনো কখনো দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। পাশাপাশি গোড়াই মিলগেট, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এবং যমুনা সেতু পূর্ব গোলচত্বরেও ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যমুনা সেতু পূর্ব গোলচত্বর পর্যন্ত প্রায় ঘণ্টাব্যাপী যানজটে পড়তে হয়।
এ ছাড়া যমুনা সেতুর পরে সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২ নামে এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পের নির্মাণকাজের জন্যও ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের।
তিনি আরও বলেন, এবার ঈদে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হতে পারে চন্দ্রা মোড়ে, কারণ এখানে বাসগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে যানজট তৈরি করে। এরপর যানজট হতে পারে বগুড়ার সোনাতলা, গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়িতে। এ পথে কিছু ওভারপাসের কাজ শেষ হয়নি, যা যানজট সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া দিনাজপুর লিংক রোডের ঘোড়াঘাট এলাকায় কিছু জটিলতা রয়েছে, সেখানে এক লেন রাস্তা হওয়ায় একদিকের গাড়ি ছাড়লে অন্যদিকের গাড়ি বন্ধ করে রাখতে হয়।
প্রতিবছর ঈদের আগে যাত্রাপথের যানজট নিরসনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সেই সভায় উপস্থিত থাকেন সড়কপথ নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তাসহ সব অংশীজন। আলোচনা হয় সমস্যা সমাধানের বিষয়ে। তারপরও সড়কের যানজট ও ভোগান্তি থামে না।
এবার আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে সারা দেশে যানজট হতে পারে এমন ১৫৯টি গুরুত্বপূর্ণ স্পট চিহ্নিত করার কথা জানানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্পট ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটে– ৫৪টি।
এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৪৯টি, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৪২টি, ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কে ৮টি এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটের ৫৪টি স্পটের মধ্যে রয়েছে– বাইপাইল মোড়, চন্দ্রা মোড়, গোড়াই মিলগেট, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে যমুনা সেতু পূর্ব গোলচত্বর, যমুনা সেতু পশ্চিম গোলচত্বর, ফেন্সিগেটের আগের অংশ, ফেন্সিগেট সার্ভিস লেন, মুলিবাড়ী আন্ডারপাসের আগে, কড্ডা ফ্লাইওভারের পশ্চিমে, কোনাবাড়ী আন্ডারপাসের আগে, হাটিকুমরুল পাঁচলিয়া বাসস্ট্যান্ড, হাটিকুমরুল ধোপাকান্দি ব্রিজ, হাটিকুমরুল গোলচত্বর, হাটিকুমরুল বাজার, ঘুরকা বেলতলা, ভূঁইয়াগাতী বাসস্ট্যান্ড, হোটেল হাইওয়ে অভিভিলা, ষোলমাইল, সিরাজগঞ্জ বাইপাস, জমজম দইঘর, বগুড়া বাজার থেকে সীমাবাড়ী কলেজ, পেন্টাগন হোটেল, ফুড ভিলেজ হোটেল, হাটিকুমরুল গোলচত্বর থেকে হাটিকুমরুল ইউনিয়ন পরিষদ, দাদপুর জামাই রোড, নিউ পাপিয়া হোটেল থেকে চাচা ভাতিজা হোটেল, জোড়া ব্রিজ, চান্দাইকোনা গরুর হাট পর্যন্ত।
এ ছাড়া ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের কাচিকাটা টোলপ্লাজা, বনপাড়া বাইপাস, বনপাড়া বাজার, রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের বানেশ্বর বাজার, রাজশাহী, ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ঘোগা বটতলা থেকে মোনায়েম কন্সট্রাকশন, ছনকা বাজার, শেরপুর মডেল মসজিদের সামনে, নয়ামাইল বাজার, মাঝিরা বাজার, ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বগুড়া জেলার শাজাহানপুর থানার বনানী বাসস্ট্যান্ড, শাকপালা, বগুড়া জেলার সদর থানার জিয়া মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে, তিন মাথা রেল ক্রসিং, চার মাথা ফ্লাইওভার ব্রিজের নিচে, বারোপুর বাসস্ট্যান্ড, মাটিডালি বিমান বন্দর মোড়, টিএমএসএসের সামনে, শিবগঞ্জ থানার মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড ফ্লাইওভারের নিচে, মোকামতলা বাসস্ট্যান্ড ফ্লাইওভারের নিচে, মায়ামনি চৌরাস্তা মোড় থেকে গোবিন্দগঞ্জ ব্র্যাক অফিস, গাইবান্ধা, পলাশবাড়ী উপজেলা পোস্ট অফিস এবং শিল্পী রেস্তোরাঁ থেকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর পর্যন্ত পলাশবাড়ী, গাইবান্ধা, পীরগঞ্জ উপজেলা বাস স্টপেজ থেকে সাসেক প্রকল্পের নির্মাণাধীন আন্ডারপাসের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত, বিশ মাইল, পীরগঞ্জ, রংপুর, বড় দরগাহ্ আন্ডারপাস, পীরগঞ্জ, রংপুর, শঠিবাড়ী আন্ডারপাস, শঠিবাড়ী বাজার এবং বাস স্টপেজ এলাকা, মিঠাপুকুর, রংপুরকে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের যানজটের গুরুত্বপূর্ণ হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সভায় যানজট নিরসনে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও হাইওয়ে পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রা থেকে যমুনা সেতু পূর্ব সড়ক
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. সিনথিয়া আজমিরী খান বলেন, মির্জাপুর থেকে শুরু করে এলেঙ্গা মোড় পর্যন্ত সড়কটি আমাদের আওতায়। এ সড়কের সব মেরামত আমরা ঈদের ১০ দিন আগেই শেষ করে দেব, যাতে যানবাহনের কোনো ধরনের ধীরগতি বা যানজট না তৈরি হয়। এ ছাড়া ভূঞাপুর-চর গাবসারা হয়ে বাইপাস রোড আছে ঢাকামুখী গাড়িগুলো আসার জন্য, সেটিরও ঈদের ১০ দিন আগেই যাবতীয় মেরামত সম্পন্ন করা হবে।
এলেঙ্গা মোড় থেকে যমুনা সেতু পূর্ব গোলচত্বর পর্যন্ত সড়কটির নির্মাণ কাজ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস বলেন, এখানে একটা নতুন রাস্তা হচ্ছে। আগের রাস্তা তো আছেই। সার্ভিস লেনও হয়েছে। সবমিলিয়ে সবগুলো সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাস্তা স্মুথ করা হচ্ছে, কাজ চলছে। ঈদের সময় যাতে যান চলাচল স্মুথ থাকে সেজন্য ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। খুব বেশি ট্রাফিক হলে যমুনা সেতু পূর্ব থেকে কন্ট্রাক সেভেনের রাস্তা খুলে দেওয়া হবে।
টাঙ্গাইল জেলা ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, এলেঙ্গা থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ফোর লেনের কাজ চলছে। সেখানে একটি নতুন রাস্তা হয়েছে। এটা দিয়ে এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতুমুখী গাড়ি আনা হবে। আর পুরোনো রাস্তা দিয়ে যমুনা সেতু থেকে এলেঙ্গার দিকে গাড়ি পাঠানো হবে। যদি গাড়ির চাপ বেশি থাকে তবে সার্ভিস লেন ও পুরোনো রাস্তা দিয়েও গাড়ি এলেঙ্গা থেকে আনা হবে। তখন ঢাকাগামী গাড়িগুলো যমুনা সেতু থেকে বের হয়ে বামে ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গা ফোর লেনে যুক্ত হবে। আমরা এমন নির্দেশই পেয়েছি।
যমুনা সেতু পশ্চিম থেকে রংপুর সড়ক
ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২)। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেতু বিভাগ। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক ৪-লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক-১ মো. আহসানুল কবীর পাভেল বলেন, এলেঙ্গা থেকে হাটিকুমরুল মোড়ের আগ পর্যন্ত আমার দায়িত্বে। এখানে ১৯ কিলোমিটার ফোর লেন সড়ক। এ রাস্তার কারণে যানজটের কোনো শঙ্কা নেই। তবুও পরে হতে পারে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক-৩ মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার দায়িত্ব রয়েছে হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার মির্জাপুর পর্যন্ত। আগামী ২৪ মার্চ হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার মির্জাপুর পর্যন্ত চার লেন গাড়ি চলাচলের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। এর মধ্যে আমরা চারটি আন্ডারপাস ছেড়ে দিয়েছি। এ পথে যানজট হওয়ার শঙ্কা নেই।
ঈদযাত্রার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সড়ক গতিশীল করতে আমরা কাজ করছি। ঈদযাত্রায় মানুষের যেন কম কষ্ট হয়, আমরা সেই চেষ্টা করছি। কষ্ট তো সব জায়গায় কমাতে পারি না, কিছু জায়গায় হয়ে থাকে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করি।
এদিকে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ১৫ রোজার মধ্যে সব রাস্তার সংস্কার কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া রাস্তার পাশের হাটবাজার সরাতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
Leave a Reply