রাজশাহীর পুঠিয়ায় চলছে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব। পুঠিয়ার রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের ম্যানেজ করে কৃষকদের তিন ফসলী জমিতে জোর করে পুকুর খননে মেতে উঠেছে প্রভাবশালী মহল। এতে পুকুর খননকারীদের দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত কৃষকদের সাথে পুকুর খননকারীদের হামলার ঘটনাও ঘটছে। কৃষকরা জমি রক্ষায় মানববন্ধন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ দিয়েও পাচ্ছেন না প্রতিকার । শুধুমাত্র পুঠিয়ার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নেই প্রায় ৫টি পুকুর খনন চলছে রাতের আঁধারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি পুঠিয়া উপজেলার বেশ কিছু ইউনিয়নে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। বিশেষ করে শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের মঙ্গলপাড়ার গড়া বিল, সুকপাড়া, আমঘোষপাড়া, সাতঘোষপাড়া, ইউসুফপুর, বাগপাড়া বিলে পুকুর খননের পরিমান অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। যে হারে পুকুর খনন চলছে তাতে ওই এলাকায় কৃষি জমি বলে কিছু থাকবে না। কৃষি জমিতে এভাবে পুকুর খনন করা হলে কৃষি ও কৃষকের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেেছন।
জানা গেছে, পুঠিয়ার মঙ্গলপাড়া গ্রামে প্রায় ৭০ বিঘা তিন ফসলী জমিতে পুকুর খনন করছেন ওই গ্রামের ইব্রাহিম হোসেন। কৃষকদের সাথে কথা না বলে কেশবখালি বিলে তিন ফসলী জমিতে জোর করে পুকুর খনন করছেন ইব্রাহিম। এ নিয়ে কৃষকরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। তারপরও অজ্ঞাত কারণে পুকুর খনন বন্ধ হয়নি। এতে কৃষকরা জমি রক্ষায় বাধ্য হয়ে মানববন্ধন করেছেন। মানববন্ধনের পর কৃষকদের উপর হামলা, মারপিটের ঘটনা ঘটছে।
এই ইউনিয়নের কানমাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনের বিলে নাটোরের নয়ন ও হাফিজ নামে দুই ব্যক্তি পুকুর খনন করছেন। এছাড়াও হাসেম আলী নামে এক ব্যক্তি পুকুর খনন করছেন গোড়াগাছীর বিলে। ছাঁতারপাড়ার বিলে পুকুর খনন করছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম রফিক। কাঁচুপাড়া বিলে পুকুর খনন করছে বাগমারার তাহেরপুরের আব্দুল লতিফ ও পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম। পুকুর খনন চলছে ভালুকগাছি ও ধোকড়াকুলেও।
জানা গেছে, বাগমারার তাহেরপুর এলাকার সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতার ইন্ধনে বখাটে মাস্তান ধরনের যুবকদের হাত করে পুকুর খনন চলছে। কারণ পুঠিয়ার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের লোকজন তাহেরপুর হাটে তাদের পণ্য বিক্রি করে থাকেন। জমির মালিকদের ভয় দেখানো হচ্ছে তারা যদি স্বেচ্ছায় পুকুর করতে জমি না দেয় তাহলে তাহেরপুর বাজারে তাদের আসতে দেয়া হবে না। এমন কি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে জমির মালিক ও কৃষকদের ভয় দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। পুকুর খনন করতে জমি না দিলে বাড়ি ছাড়া বা গ্রাম ছাড়া করা হবে এমন ভয় দেখানো হচ্ছে কৃষকদের। এতে বাধ্য হয়েই অনেক কৃষক প্রাণের ভয়ে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তিন ফসলি জমি।
পুঠিয়ার মঙ্গলপাড়া গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম জানান, শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের মঙ্গলপাড়াগ্রামের কেশবখালির দাড়া সংলগ্ন বিলে তিন ফসলী জমিতে পুকুর খনন করছেন ইব্রাহিম। এখানে পুকুর খনন করা হলেও পুরো বিলের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। যেখানে পুকুর খনন করা হচ্ছে সেখান দিয়ে বিলের পানি নিষ্কাশন হয়। এই পানি নিষ্কাশনের জয়গা বন্ধ করা হলে কৃষকদের মাঝে হাহাকার শুরু হবে।
তিনি বলেন, আমাদের জমি রক্ষায় ইতোমধ্যে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেছি। জমি রক্ষায় প্রয়োজনে আন্দোলন শুরু করবো। কৃষক সবুর আলী বলেন, পুঠিয়ার কানমাড়িয়ায় যেখানে পুকুর খনন হচ্ছে ওই জমিতে পিঁয়াজ রোপন করেছি। কিন্তু পুকুর খননকারীরা আমাকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। আমি স্বেচ্ছায় জমি না দিলে জোর করে তার জমিতে পুকুর খনন করা হবে বলেও তাকে জানানো হয়েছে। এতে জমি রক্ষায় তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন।
এব্যাপারে পুকুর খননকারী ইব্রাহিম জানান, পুকুর খনন শুরু করার পর স্থানীয়রা বাধা দিলে আমি কাজ বন্ধ রেখেছি। কৃষি জমিতে কেনো পুকুর খনন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃষকরা অনুমতি দিয়েছে সেখানে পুকুর খনন করতে তাই করছি।
পুকুর খননকারী হাসেম আলী বলেন, আমি আওয়ামীলীগের নেতাদের টাকা দিয়েছি, প্রশাসনকে দিয়েছি, সাংবাদিকদের দিয়েছি। তাহলে কেনো পুকুর খনন করতে পারবো না। আমার বিরুদ্ধে তো আর কেউ অভিযোগ দেননি। তিনি বলেন, আমি সবাইকে ম্যানেজ করেই পুকুর খনন করছি।
এব্যাপারে শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, আমি আমার ইউনিয়নের কৃষি জমি রক্ষায় সর্বাত্ম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যারা পুকুর খনন করতে বিলে নামছে আমি লোক পাঠিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। শিক্ষামাড়িয়া ইউনিয়নের কৃষি জমি বাঁচাতে আমি জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা চেয়েছি।
পুঠিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, আমরা পুকুর খননের বিষয়টি জানলেও কিছু করার থাকে না। কারণ ওই বিষয়গুলো দেখভাল করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। তবে পুকুর খনন নিয়ে কোনো মারামারি বা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে বিষয়টি আমরা দেখি।
পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ কে এম নূর হোসেন নির্ঝর বলেন, পুকুর খননের বিষয়টি আমরা জানতে পেলেই সেখানে অভিযান চালাচ্ছি। রাতের আধাঁরেও অনেকেই পুকুর খননের চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমি অভিযান চালিয়ে সেগুলা বন্ধ করছি। তিনি আরো বলেন, আমি সাত মাস হলো পুঠিয়া উপজেলায় যোগদান করেছি। এই সময়ের মধ্যে পুঠিয়ার কোথায় একটি পুকুরও খনন হয়নি। কাউকে কৃষি জমিতে খনন করতে দেয়াও হবে না। তিনি বলেন, শিলমাড়িয়া ও ভালুকগাছি ইউনিয়ন নিচু এলাকা হওয়ায় পুকুর খননকারীদের দৃষ্টি এ দুটি ইউনিয়নের দিকে। তবে আমি পুঠিয়ায় থাকা অবস্থায় কৃষি জমিতে কোনো ধরনের পুকুর খনন করতে দেয়া হবে না।
Leave a Reply