বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শুভ্র বোস, কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তাকে নিয়মিত রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার করতে হয়। বেশিরভাগ সময় অল্প দূরত্বে যেতে (১০০ টাকার নিচে ভাড়া এলে) তিনি কোনো রাইড পান না।
আবার দূরের যাত্রায় তারা (চালক) বিভিন্ন আবদার করে বসেন। কোনো সময় অ্যাপে যে সড়ক দেখায়, সেটিতে না গিয়ে অন্য রাস্তায় যেতে চান; অ্যাপে পুরো রাস্তার যে ভাড়া দেখায়, সেটির সঙ্গে আলাদা অর্থ দাবি করেন। আবার কল ধরে এলেও প্যাসেঞ্জারকে বাধ্য করে খ্যাপে যেতে। অনেক সময় অ্যাপের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দাবিও করেন।
শুভ্র এমন জ্বালাতনের শিকার বহু দিন ধরে। কিন্তু জরুরি কাজে বের হতে হয় বলে কিছু করার থাকে না। প্রতিনিয়ত এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয় তাকে।
নারী যাত্রীদের বিপদের মাত্রা একটু বেশি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী নাজনীন ফারজানা জানালেন, রাইড শেয়ারিং আসায় গণ-পরিবহনে হওয়া হয়রানি থেকে অনেকটা ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। শুরু থেকেই তিনি জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং পাঠাও-উবার ব্যবহার করছেন। এখন পর্যন্ত হয়রানির শিকার হননি; কিন্তু সমস্যা হলো- অনেক চালক যাত্রী হিসেবে মেয়েদের নিতে চান না। আজকাল অনেক নতুন ও অনভিজ্ঞ চালক রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে, যারা ‘বেসিক ম্যানার’ জানে না। সেই সঙ্গে ভাড়ার বিষয়টি তো আছেই।
আরেক কর্মজীবী মেহেরুন নাহার মেঘলা বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হচ্ছে কনফার্ম করার পর রাইড কল ক্যানসেল করে দেওয়া। অনেক চালক রাইড অর্ডার গ্রহণ করেন। কিন্তু পিক আপ পয়েন্টে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাইড ক্যানসেল করে দেন। সকালের দিকে এ সমস্যায় পড়তে হয় অনেক বেশি। ফলে অফিসে বা জরুরি কোনো কাজে যেতে অনেক সময় নষ্ট হয়। সকালের দিকে এখন প্রায় রাইড পাওয়াও যায় না।
তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনায় মেঘলা আরও বলেন, রাইড শেয়ারিং সেবা ব্যবহার করতে গিয়ে কিছু বাজে ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে সাজগোজ নিয়ে মন্তব্য করেছে। বলেছে ‘আপা, আপনি বড় টিপ পরেছেন কপালে, আরেকটু ছোট টিপ পরলে আপনাকে ভালো লাগবে। ’ অনেক রাইডার পরবর্তী সময় হোয়াটসঅ্যাপে নক দিয়ে বিব্রতকর ম্যাসেজ দিয়েছে। একাধিক রাইড শেয়ারিং অ্যাপ প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব ব্যাপারে অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাইনি।
যাত্রীদের অভিযোগ রয়েছে হেলমেট নিয়েও। নীতিমালায় চালকের সঙ্গে থাকা রাইডারের হেলমেটের নির্দেশনা নেই। তাই চালকরা খুব বাজে মানের হেলমেট সাথে রাখেন। এসব হেলমেটেরও রয়েছে নানা সমস্যা। কোনো কোনোটিতে ঘামের বাজে গন্ধ, কোটা ফাটা, ভেতরের প্যাড ছেড়া-ময়লা ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো- শুধুমাত্র ট্রাফিক পুলিশের মামলার ভয়ে রাইডাররা কোনো রকম হেলমেট সঙ্গে রাখেন।
নগরবাসীকে যানজটের শহরে গণ-পরিবহনের চেয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চালু হয়েছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ। পাঠাও, উবারসহ রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো জনপ্রিয়তাও পেতে থাকে। কিন্তু কোনো ভালো উদ্যোগই ঢাকায় টিকতে পারে না। অথচ, বিশ্বের অন্যান্য দেশে রাইড শেয়ারিং অনেক বেশি স্বস্তির। সেখানে চালকদের কোনো বাজে অভ্যাস নেই। নেই প্যাসেঞ্জারকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার নিত্য আচরণ।
অ্যাপের ভাড়া খ্যাপে আদায়; খ্যাপের ভাড়া বাড়তি, যদি এমনটাও হতো- হয়ত মেনে নিতে পারতেন যাত্রীরা। কিন্তু রাইডাররা তাদের নতুন নতুন অভ্যাসের দাস। রাস্তার ধারে ধারে তারা মোটারসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। যাত্রীদের রাইড অর্ডারের কল বাজতেই থাকে। নিজেদের মধ্যে রাইডাররা গল্প-হাসাহাসি করেন। কেউ যদি বলেন, ‘যাবেন ভাই?’ বাসের হেলপারের মতো টানাটানি শুরু করেন। যার সাথে বায়না হয়, তিনি আবার বেশি ভাড়া দাবি করেন। বায়নায় না পোষালে আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দেন। পেছন থেকে গালাগালিও করেন।
অ্যাপের বদলে যাত্রী নিতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোটরসাইকেলের হাট যেকোনো রাস্তায় দেখা যায়। রাজধানীর প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি অ-গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় এ দৃশ্য প্রতিদিনকার। রাস্তা দখল করে এভাবে ৫-১০টি মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখা এটি আইন বহির্ভূত। ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরাও তাদের কিছু বলেন না। এসব রাইডারদের কারণে যানজটও সৃষ্টি হয়।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপের বদলে খ্যাপ বা দরকষাকষি করে যাত্রী নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় অনেকের কাছে। শামীম হোসেন নামে একজন রাইডার বলেন, অ্যাপে গেলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় আমাদের। যে কারণে অ্যাপ ব্যবহারে চালকরা দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছেন।
অনিক নামে একজন জানালেন, অ্যাপের কমিশন বাদ দিলে দৈনিক চলাচলের তেল খরচ, বাইকের নানা সমস্যা; নিজের জন্য খরচ করে আয়ের টাকা থাকে না। যে কারণে খ্যাপকেই তারা গুরুত্ব দেন। এতে অন্যান্য খরচগুলোও চালিয়ে নিতে পারেন। টাকা জমাতেও পারেন।
নিম্নমানের হেলমেটের ব্যাপারে চালকদের ভাষ্য, ভালো হেলমেট রাখলে চুরি হয়ে যায়। যাত্রীদের অসচেতনতায় হাত থেকে পড়ে ভেঙে যায়। বৃষ্টির দিনে ভিজে গেলে শুকিয়ে আনাও কষ্টকর। যে কারণেই ‘নরমাল’ হেলমেট ব্যবহার করেন তারা।
দেশের সড়ক আইনে বলা হয়েছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া পরিবহণ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনো ধরনের ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কার্যক্রম মোটরযানে পরিচালনা করা যাবে না। সে হিসেবে অ্যাপ ছাড়া যেভাবে রাইড শেয়ারিং সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা বে-আইনি।
আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো মোটরযান দ্বারা চালক, যাত্রী, সড়ক ব্যবহারকারী বা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সরকার বা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে কর্তৃপক্ষ সেই যান সড়ক থেকে প্রত্যাহার বা সড়কে চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিতে পারবে। নির্ধারিত এলাকা ব্যতীত মোটরযান পার্কিং করা যাবে না এবং যাত্রী বা পণ্য উঠা-নামার নির্ধারিত স্থান ও সময় ব্যতীত মোটরযান থামানো যাবে না।
এমনকি ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’য় বলা হয়েছে, নির্ধারিত স্ট্যান্ড বা অনুমোদিত পার্কিং স্থান ব্যতীত কোনো রাইডশেয়ারিং মোটরযান যাত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাস্তায় যেখানে-সেখানে অপেক্ষমাণ থাকতে পারবে না। অর্থাৎ যাত্রী ওঠা- নামা ব্যতীত এরূপ মোটরযানকে সবসময় চলাচলরত অবস্থায় থাকতে হবে।
কিন্তু ঢাকার রাস্তায় এ আইন যাত্রী সেবা দেওয়া কোনো মোটরসাইকেল চালক মানেন না। এমনকি ট্রাফিক সংশ্লিষ্টরাও তাদের কিছু বলেন না। এসব অভিযোগ সাধারণ জনগণের। কেননা, যারা রাস্তায় চলাচল করেন- মোটরসাইকেলের এ পসরা তাদের প্রতিনিয়ত বিরক্ত করে চলেছে।
শৃঙ্খলা ফেরাতে যা ভাবছে বিআরটিএ
রাইড শেয়ারিং কেন্দ্রিক অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করতে অ্যাপ চালু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। খুব দ্রুতই এ বিষয়ে আদেশ জারি হবে। এবং তার তিন মাসের মধ্যে গ্রাহক অ্যাপ ব্যবহার করে অভিযোগ জানাতে পারবে বিআরটিএকে।
এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, রাইড শেয়ারিং কেন্দ্রিক সব ধরনের অব্যবস্থাপনা মনিটরিং করার জন্য এ অ্যাপ চালু করা হচ্ছে। একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ করছে।
অ্যাপে কি ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, গ্রাহক অ্যাপ ইন্সটল করার পর সেখানে অভিযোগ কেন্দ্রিক অপশন থাকবে। যে ধরনের অনিয়মের সম্মুখীন তারা হবেন সেটি নিয়ে জানাতে পারবেন।
রাইড শেয়ারিং চালকদের চিহ্নিত করতেও বিআরটিএ নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বিষয়ে চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, এ ধরনের অব্যবস্থাপনা এড়াতে বাইকারদের এক রঙের হেলমেট দেওয়া হবে।
বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে, এর আগে এক রঙের ড্রেস কোড নির্ধারণ করা হলে তা নিয়ে আপত্তি জানায় কোম্পানিগুলো। পরে আলোচনা করে হেলমেট নির্ধারণ করা হয়।
Leave a Reply