দখল আর দূষণে ধুকছে রাজশাহী বিভাগের অন্তত ৪০টি নদ-নদী। দুইপাড় দখলের কারণে বেশিরভাগ নদ-নদী মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। আবার সরকারের গৃহীত অপরিকল্পিত পদক্ষেপই কিছু নদ-নদীর মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে। রাজশাহী বিভাগীয় নদী বিষয়ক কর্মশালায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর একটি হোটেলের সম্মেলন কক্ষে এই কর্মশালার আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা)। কর্মশালা সঞ্চালনা করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। কর্মশালায় রাজশাহী বিভাগের নদীগুলোর বর্তমান চিত্র তুলে ধরা হয়।
এতে উঠে আসে, রাজশাহী বিভাগের ৪০টি নদ-নদী এখন দখল-দুষণে মৃতপ্রায়। অনেক নদী একেবারে হারিয়ে গেছে। কোন কোন নদী দখলের কারণে দীর্ঘ এলাকায় এর কোন অস্তিত্ব নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ভুল সিদ্ধান্তের কারণেও নদীর মৃত্যু হয়েছে।
রাজশাহীর চারঘাট থেকে শুরু হওয়া বড়াল নদেরও মৃত্যু হচ্ছে পাউবোর ভুল সিদ্ধান্তে-এমন অভিযোগও আনা হয়েছে বেলার তথ্যে। এতে বলা হয়, চারঘাটে পদ্মার শাখা হিসেবে বড়াল নদের উৎপত্তি। ২২০ কিলোমিটার এর দৈর্ঘ্য। এই নদীর সঙ্গে সংযোগ ৫০ লাখ মানুষের। কিন্তু দখলের কারণে নাটোরের বড়াইগ্রামে প্রায় ১৮ কিলোমিটার এই নদীর কোন অস্তিত্ব নেই। নদীটির মৃত্যুর জন্য পাউবোর ভুল সিদ্ধান্তও দায়ী।
১৯৮১ সালে বড়ালের উৎসমুখে স্লুইসগেট দেয় পাউবো। তারপর থেকেই এ নদে পানিপ্রবাহ কমতে থাকে। ১৯৮৫ সালে নদের ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরেকটি বাঁধ পড়ে। এরপর ১৯৮৫ সালে নদের ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে তিনটি ক্রস বাঁধ দেওয়া হয়। এতে নদের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে। এভাবে বিভাগের আট জেলার অন্তত ৪০টি নদ-নদী মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। তবে এসব নদীর প্রাণ বাঁচাতে বেশকিছু সুপারিশ উঠে আসে কর্মশালায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদ-নদীকে বাঁচাতে প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে গবেষণা করতে হবে। করতে হবে নদীর ডাটাবেজ। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সব নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। দখল-দুষণসহ নদীবিরোধী সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। নদীর ওপর নির্মিত ছোট ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। শোধন ছাড়া কোন বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না। শহরে নদীর দুইধারে পায়ে হাঁটা রাস্তাসহ বসার ব্যবস্থা করে নগর পরিকল্পনা করতে হবে। নদীপাড়ে লাগাতে হবে ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। লোকায়ক জ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে এলাকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখে নদী সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি নদী রক্ষায় নিতে হবে আইনি পদক্ষেপ। তাহলেই নদ-নদীগুলো টিকে থাকতে পারবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদী রক্ষায় বেলা কাজ করছে। কিন্তু এমনও দেখা গেছে, যদি কেউ নদী রক্ষার জন্য বেলার কাছে নালিশ করে তখন তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা হয়ে গেছে। অভিযোগকারী হয়ে গেছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামি। তাঁরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন। কারণ, দখলকারীরা প্রভাবশালী। গত দুইমাসে এই ধরনের সাতটি ঘটনার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোন করতে হয়েছে তাঁকে। এখনও নদী রক্ষার আন্দোলনে সামিল হয়ে কেউ ভুক্তভোগী হলে বেলা তাঁকে আইনগত সহায়তা দেবে। নদী ও পরিবেশ রক্ষায় তিনি সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. আ.ন.ম ওয়াহিদ।
এছাড়াও মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন স্থানীয় দৈনিক সোনালী সংবাদের সম্পাদক লিয়াকত আলী, দৈনিক সোনার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আকবারুল হাসান মিল্লাত, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান প্রমুখ।
Leave a Reply